গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’

অনলাইন ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:০৯

সাধারণের কাছে নারায়ণগঞ্জ শব্দটিতে ভীতি ছিল দীর্ঘদিন যাবৎ। এর নেপথ্য ঘটনা বহুবিধ। এ অঞ্চলে অনিয়মই ছিল নিয়ম, হত্যা ছিল স্বাভাবিক ঘটনার মতোই, প্রাচ্যের ডান্ডি হয়ে গেল মাদকের স্বর্গরাজ্য। তবে খুব সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জকে ঘিরে দুটি ঘটনা ওই অঞ্চল তো বটেই, পুরো দেশের মানুষের মাঝে নিয়ে এসেছে স্বস্তি। ক. গত বছরের শেষদিকে হয়ে যাওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন; খ. চলতি মাসে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের বিচারের রায়।

ঘটনাগুলো যদিও নারায়ণগঞ্জকেন্দ্রিক তবে ইমপ্যাক্ট পুরো দেশের। অস্বীকার করার সুযোগ নেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। এখনো হামাগুড়ি পর্যায়ে আছে। অথচ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের যে সংবিধান আমাদের উপহার দিয়েছেন তাতে প্রস্তাবনা অংশে ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘আইনের শাসন’ শব্দ দুটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ একটি মূলনীতি এবং আরও বলা আছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক-মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। সুতরাং সে দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, নারায়ণগঞ্জের ঘটনা দুটো পুরো দেশের জন্য শুভ সংকেত। এ দুটি বিষয় নিয়ে দেশের মানুষের ভেতর হা-হুতাশ রয়েছে।

দুই.

সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অনুসারী অন্যসব রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের আমলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান আবার ফিরে এসেছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার বাইরে সবাই কমিশনকে মেনে চলে, ভয় পায়। কারণ কমিশন কোথাও কোনো ছাড় দেয় না, ক্ষমতাসীন বলয়ের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে না। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, সরকারের নয়। সরকারের দায়িত্ব হলো নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা।

বিগত দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর অনিয়ন ও অসচ্ছতা নিয়ে দেশের মিডিয়া এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলোকে কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে দেখা যায়নি। দেশের স্বনামধন্য সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’, যারা কি না বড় সমালোচক হিসেবে পরিচিত তারাও নির্বাচন-পরবর্তী ফলাফল নিয়ে সংবাদ শিরোনাম করেছে ‘নির্বাচন সুষ্ঠু, নৌকা প্রার্থীর জয়।’ অন্যদিকে দেশের অন্যতম নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে কোনো সহিংসতা দেখতে পাইনি। কাউকে জাল ভোট দিতে দেখিনি। আমাদের সামনে কোনো ভোটারকে বাধা দেওয়া হয়নি। এ কারণে আমাদের পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। ভোটগ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করায় ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন।’ শুধু তাই নয়, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ আনতে পারেননি। যে বক্তব্য এসেছে সেটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।

তিন.

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা স্তব্ধ করে দিয়েছিল গোটা জাতিকে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকা-ের বিচার দাবিতে সরব হয়েছিল দেশের জনগণ। সম্প্রতি সেই মামলার রায়ে নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালত ৩৫ আসামির ২৬ জনকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন। বাকিরাও পেয়েছেন বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-। মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচ বাহিনীর ১৬ কর্মকর্তা রয়েছেন। সাত খুনের এ ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলার বিচারকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। বিচার শুরুর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্যÑ ক. মামলা দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখা হয়নি; খ. মামলার কার্যক্রম প্রভাবমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই মামলার সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আশংকা ছিল জনমনে। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। বিষয়টি সবাই জানে, সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের এক মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়ও খুনের ঘটনায় জড়িত। যেটি সাধারণত এই দেশে হয়ে আসতে দেখেছে জনগণ, প্রভাবশালীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেক অপরাধ থেকে রক্ষা পেয়ে যান। এবার তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। এ রায়ে প্রমাণিত হলো, দেশে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। যতই শক্তিশালী হোক, যেই বাহিনীরই লোক হোক না কেন, অপরাধ করলে তার বিচার হওয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে বিচার হয়েছে। বলতে পারি, দেশ আইনের শাসনের পথে নজির সৃষ্টি করেছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্ববাসীর কাছে আরও উজ্জ্বল হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে বাদীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি উচ্চ আদালতে যাবে। সেখানেও এই শাস্তি বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মিডিয়াকে বলেছেন। এ রায়ে আরও একটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলা ছাড়া এক মামলায় একসঙ্গে ২৬ জনকে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা নিকট-অতীতে নেই। বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের তিন শতাধিক সদস্যকে ফাঁসির দ- দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রেও নারায়ণগঞ্জের রায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ খ্যাত যে চমৎকার দুটি উদাহরণ রয়েছে আমাদের হাতে সেটি যাতে রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় সে প্রত্যাশা জনগণের।

ড. বদরুল হাসান কচি : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :