সামাজিক বনায়নে বিআরডিবি হতে পারে প্রধান হাতিয়ার

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
 | প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:১৫

বৃক্ষ বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। খরা, প্রচণ্ড তাপদহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, মাটির ক্ষয়রোধ, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সহ আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। বৃক্ষ ছাড়া পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হতো। তাইতো বৃক্ষকে বলা হয় প্রাণের অগ্রদূত।

মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হতে শুরু করেছে, নিজেকে নিয়ে মানুষ এখন ভাবতে শিখেছে। কী খাবে, কী খাবে না এ নিয়ে মানুষের সচেতনতার সীমা নাই। অথচ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের পরিমাণ কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে মানুষের সামান্য মাথাব্যাথা নাই। বাংলাদেশকে সবুজ শ্যামল প্রকৃতির দেশ বলা হলেও এখানে প্রয়োজনের তুলনায় সবুজের পরিধি খুবই কম।

পরিবেশবাদীদের মতে, একটি দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। অথচ বাংলাদেশে সে পরিমাণ বনভূমি নেই। সরকারি হিসেবে মতে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭.৫০ শতাংশ। ইউনোস্কোর হিসেবে বনভূমির পরিমাণ আরও কম।

সরকার দেশে বনভূমির পরিমাণ ২৫ শতাংশে এ উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়ে কাজ করছে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ এর ৪৫ এর ১( ট ) ধারায় পরিবেশ উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের জন্য একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃক্ষ রোপণ অভিযানসহ নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। বিশেষ করে বিআরডিবির কৃষক সমবায় সমিতিগুলো বৃক্ষ রোপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

বৃক্ষরোপণে বিআরডিবির কৃষক সমবায় সমিতি এক বিশাল শক্তি। সমবায়কে কাজে লাগিয়ে ভারত ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। জাপান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো সমবায়কে অর্থনীতির তৃতীয় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নরওয়ে ও সুইডেনে সমবায়ের মাধ্যমে কল্যাণমুখী অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের কৃষক সমবায় সমিতিগুলোর সার্বিক কর্মকাণ্ডের ফলে জাতীয় পর্যায়ে জিডিপিতে বিআরডিবির অবদানের পরিমান হচ্ছে ১.৯৩ শতাংশ। কাজেই আমরা যদি বাংলাদেশের কৃষক সমবায় সমিতিগুলোর শক্তিকে বৃক্ষরোপণে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবো- এ সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা

শ্যামলে ভরা প্রকৃতির অপরূপ বাংলাদেশে সবুজের সমারোহ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে নির্বিচারে বনাঞ্চল কেটে উজাড় করা হচ্ছে। প্রতি বছর যে পরিমাণ গাছ কাটা হয় সে তুলনায় গাছ লাগানো হয় কম। ফলে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যানবাহন, কলকারখানা, আগুন, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড প্রতিদিন পরিবেশ দূষিত করছে।

বন ধ্বংসে যেমন দেশের মানুষ ভূমিকা রাখছে তেমনি বর্হিবিশ্বের পরাশক্তিসমূহের অপতৎপরতাও কম নয়। আবাসনের নামে অপরিকল্পিতভাবে বন ধ্বংস করা হচ্ছে। এছাড়া জ্বালানি হিসেবে মাত্রাতিরিক্ত কাঠ ধ্বংস করছি। বন ধ্বংসের এ মহাযজ্ঞের কুফল বর্তমানে উপলব্ধি করতে না পারলেও নিকট ভবিষ্যতে এটা আমাদের জন্য দুর্যোগ বয়ে আনবে।

একমাত্র বৃক্ষই প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থ ও নির্মল রাখতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় বৃক্ষরোপনকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। ব্যক্তি, জাতীয় স্বার্থে এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সুস্থ্য, সুন্দর পরিবেশ পেতে দেশের প্রতিটি নাগরিককে বৃক্ষ রোপন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে। তাহলে আমরা বসবাসের জন্য সুন্দর, সুস্থ ও নির্মল পরিবেশ ফিরে পাবো।

সামাজিক বনায়নে বিআরডিবির কৃষক সমবায় সমিতির অবদান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তুলতে তিনি মেধা, শ্রম,ধ্যান-জ্ঞান এক কথায় সর্বশক্তি বিনিয়োগ করেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বাংলাদেশকে একটি আত্ম-নির্ভরশীল, ক্ষুধা- দারিদ্রমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই গ্রামের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর এই পরিবর্তনের জন্য তিনি ১৯৭১ সালে দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন। প্রথমত. কৃষির উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন এবং কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকুরিতে তিনি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে গেছেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন বর্ধিত জনগোষ্ঠীকে খাওয়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর উৎপাদন বাড়াতে হলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। এর জন্য দক্ষ কৃষি বিজ্ঞানী গড়ে তুলতে হবে। সুতরাং কৃষি গ্রাজুয়েটদের মর্যাদার আসনে না বসালে এ সেক্টরে মেধার সমাবেশ ঘটবে না। বর্তমানে উন্নত জাতের ধান বীজসহ বিভিন্ন ধরনের প্রধান ও অপ্রধান শস্যের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। উন্নত ফসল উৎপাদন কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে এর সবই বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নের ফসল।

দ্বিতীয়ত. গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করে কৃষি ও অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ও মূলধন সহায়তা প্রদানসহ পল্লীর জীবন মান উন্নয়ন এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যই তিনি ষাট এর দশকে ড. আখতার হামিদ খান কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’ (আইআরডিপি) তথা বিআরডিবিকে ১৯৭২ সালে সারাদেশে সম্প্রসারণ করেন।

বিআরডিবির মূল কর্মসূচি এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কৃষক সমবায় সমিতিসহ মোট প্রাথমিক সমবায় সমিতির সংখ্যা এক লাখ ৭২ হাজার ৩৫৭ টি। সমিতির সদস্যসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ১৫৬ জন এবং মোট উপকারভোগীর সংখ্যা দুই কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮০ জন। বিআরডিবি সমিতির বিপুল এ সদস্যদেরকে আইজিএভিত্তিক ঋণ প্রদানের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়ন, সমিতি ও সেচ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদি পশু পালন, স্যানিটেশন ও বৃক্ষ রোপণসহ নানাবিধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ প্রশিক্ষিত জনশক্তিতে রূপান্তরিত করেছে।

প্রশিক্ষিত এ কৃষক সমবায় সমিতির সদস্যগণ নিজেরা যেমন বৃক্ষ রোপণ করে ঠিক তেমনি গ্রামের অন্যকেও বৃক্ষ রোপণে উৎসাহিত করে। তাছাড়া বিআরডিবি থেকে ঋণ গ্রহণের সময় প্রত্যেক ঋণ গ্রহীতা কৃষক সমবায় সমিতির সদস্যকে একটি করে গাছের চারা উপহার দেয়া হয়। এভাবে হিসেব করলে দেখা যায় কৃষক সমবায় সমিতির সদস্যদের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি বৃক্ষরোপণ হয়। সুতরাং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে দেশের বনভূমি উন্নয়নে কৃষক সমবায় সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ।

বনায়নে বিআরডিবির কৃষক সমবায় সমিতিগুলোকে সম্পৃক্তকরণ

জাতীয়ভাবে ‘বৃক্ষরোপণ অভিযান’ শুরু হলেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের অনেক বিশিষ্টজন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বৃক্ষ চারা রোপণ করেন।

আবার বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয় থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি এবং গোটা দেশবাসীকে গাছ লাগানো সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় সে উদ্যোগ সীমিত। আবার শোভাযাত্রা করে ‘গাছ লাগাই পরিবেশ বাঁচাই’ স্লোগানের মাধ্যমে যে চারাটি রোপন করা হয় সেটিরও কোন যত্ন নেয়া হয় না । তাই দেখা যায় বর্ষা মওসুম আসলেই বৃক্ষ রোপণের জন্য যারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের অধিকাংশ সংখ্যকেই সারাবছরেও একবার রোপিত সে বৃক্ষটির খোঁজ নেন না। যার ফলে অযত্নে চারাটির আর বেড়ে ওঠা হয় না। সেটা কোন পশুর খাদ্য কিংবা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে যায়।

সরকারি উদ্যোগে গাছ লাগানো কর্মসূচিতে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ এবং খরচ হলেও টাকা বিনিয়োগের তুলনায় উপকার হয় সামান্যই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণে প্রশিক্ষিত ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ১৫৬ জন কৃষক সমবায় সমিতির সদস্যকে কাজে লাগাতে পারলে সরকার বৃক্ষরোপণে দ্রুত সফলতা অর্জন করবে। কারণ প্রশিক্ষিত সদস্যের মাধ্যমে রোপিত গাছের চারা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। একজন প্রশিক্ষিত কৃষক সমবায় সমিতির সদস্য যদি প্রতি বছর ১০টি করে নতুন গাছের চারা রোপণ করে, তাহলে দেশে শুধুমাত্র কৃষক সমবায় সমিতির মাধ্যমে প্রতি বছর বৃক্ষ রোপিত হবে (৫৪,৫১,১৫৬ জন × ১০ টি)= পাঁচ কোটি ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৫৬০ টি। যা দেশের বনভূমির উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে।

এক্ষেত্রে সরকার বিআরডিবির মাধ্যমে একটি প্রকল্প হাতে নিতে পারে অথবা কৃষক সমবায় সমিতিগুলোকে বিআরডিবির উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে বন বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত করে বৃক্ষ রোপণে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে পারে।

আমেরিকার ওকলোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যার প্রফেসর জর্জ হাউসটন তাঁর ‘Nature’ গ্রন্থে বলেছেন ‘Trees, Trees and Trees are only The creature of God’. গাছ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জীব, যা ছাড়া বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই।

আসুন বিআরডিবির কৃষক সমবায় সমিতিগুলোর প্রশিক্ষিত বিশাল জনশক্তিকে বৃক্ষ রোপণের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করে নতুন প্রজন্মকে একটি সবুজ সুন্দর পৃথিবী উপহার দিই।

লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক. বিআরডিবি অফিসার্স এসোসিয়েশন, ঢাকা ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :