সার্চ কমিটির তালাশ

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৪০

মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা। এমন একটা নির্বাচন কমিশন, যার অধীনে সকল রাজনৈতিক দল হাসিমুখে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে।

এমন নির্বাচন কমিশন কি আগে কখনো বাংলাদেশে ছিল? এমন কোনো কমিশন কি ছিল যার ব্যাপারে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনেনি? এরশাদ পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সরকারের আমলে যে নির্বাচন হয়, সে সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। তিনি যে নির্বাচনটি পরিচালনা করেন, সেটা ১৯৯১ সালের কথা, তাতে বিজয়ী হয় বিএনপি। খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় সে নির্বাচন। টেলিভিশনে সরাসরি ঘোষণা করা হয় ফলাফল। একটি একটি করে আসনের ফল আসছিল, আর তা প্রচার করা হচ্ছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছিল না, কে যাচ্ছে ক্ষমতায়। এই যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তারপরও হেরে যাওয়া দল কি নির্বাচনের ফলকে মেনে নিয়েছিল? না নেয়নি। বরং অভিযোগ তুলেছিল সূক্ষ্ম কারচুপির। এরপর অনেক নির্বাচন কমিশন এলোÑ আবু হেনা, এম এ সাঈদ, বিচারপতি আজিজ, এ টি এম শামসুল হুদা, রকিবউদ্দিন, এদের নেতৃত্বে ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন কমিশন। এর কোনোটির পারফরমেন্সে খুশি ছিল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সকল দল, বিশেষ করে পরাজিত দল?

সেদিন এক সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, আচ্ছা এই যে এতগুলো নির্বাচন কমিশন গেল, এর মধ্যে আপনার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ কোনটি? একমাত্র আজিজ ছাড়া প্রতিটি কমিশনই তো কোনো না কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করেছে। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আলোকেই বলুন।

তিনি কিছুটা সময় নিলেন। ভাবলেন, তারপর বললেন- হুদা কমিশন?

হতে পারে। কিন্তু এম এ সাঈদ কমিশনকে মন্দ বলবেন কেন? আওয়ামী লীগের নিয়োগ করে যাওয়া ওই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেই তো বিএনপি জয় পেল।

হুম, সেটাও ভালো ছিল।

আবার আবু হেনা কমিশন? কিংবা আমি যদি জাতীয় নির্বাচনকেই তুলনার মাপকাঠি ধরি, তাহলে রউফ কমিশন যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটা পরিচালনা করলো, সেটাকে কি বলা যাবে? আমার তো মনে হয় স্বাধীনতার পর প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন রউফ কমিশনের অধীনেই হয়েছিল।

আমার বিজ্ঞ সহকর্মী দ্বিমত করলেন না। বললেন, আসলেই কিন্তু মাগুরার উপনির্বাচনের আগে পর্যন্ত রউফ সাহেবের কোনো বিতর্কিত কাজ কিন্তু চোখে পড়ে না!

অথচ দেখুন, বলছিলাম আমি, এই প্রতিটি নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। নির্বাচনে পরাজিত দল প্রত্যেকবার নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

তবে আমার মনে হয়, কেবল আমার ওই সহকর্মীই নয়, আরও অনেকের কাছেই হুদা কমিশনকেই তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে ভালো বলে মনে হবে। কেন মনে হয়? বীভৎস বর্তমানে দাঁড়িয়ে মানুষ সদ্য অতীতের দিনগুলোকে স্মরণ করবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক। বিএনপির কোনো নেতাকেই যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তারাও কিন্তু হুদা কমিশনের প্রশংসা করবেন। অথচ এই বিএনপিই হুদা কমিশনের বিষয় কি প্রবল বিরোধিতাই না করেছে। তাহলে কি ভালো-মন্দের চিরন্তন চেহারা নেই। আজ যে মন্দ, কাল সে অধিকতর মন্দের কারণে ভালো হয়ে যাবে? তাহলে বাংলাদেশে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পাওয়ার বিষয়টা কি সোনার পাথরবাটির মতো? গত কিছুদিন ধরে সেই সোনার পাথরবাটি তৈরির কারিগর খোঁজা হলো। দেশের সর্বোচ্চ আসনে থাকা মানুষটি উদ্যোগ নিলেন। যারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, সেই রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করলেন। জানালেন তাদের মতামত। আলোচনা শেষ করে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে প্রতিটা দল বললেন তারা আশাবাদী। এত এত আশাবাদের পরই ঘোষিত হলো বহু প্রত্যাশিত সেই কারিগরদের, অর্থাৎ সার্চ কমিটির নাম।

রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির ছয় সদস্যের নাম ঘোষণা করেছেন। সেই নামগুলো নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বলছে, এই কমিটি আওয়ামী ভাবাপন্ন। এর জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রথমেই উচ্চারণ করছেন কমিটির এক সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নাম। নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে গিয়ে আরও এক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখলাম ওই একটি নামই বলতে। তাদের বিবেচনায় কমিটিতে কি তাহলে নিরপেক্ষ ওই একজনই?

কমিটির আর এক সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. শিরীন আখতার। তার নাম কমিটিতে আছে জেনে তিনি একটি রেডিওকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কি বললেন? বললেন- ‘এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমাদের দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি কোনো দায়িত্ব আমাদেরকে দেন, সেটাকে আমি অবশ্যই আমার অত্যন্ত পবিত্র দায়িত্ব বলে সম্পাদন করতে সচেষ্টা হবো।’ এই বক্তব্য শুনে ওনাকে কি নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে? এ প্রশ্নটা আমি ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাসে দিয়েছিলাম। সেখানে আমার এক বন্ধু মন্তব্য করলেন, দেশে কি কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তির অস্তিত্ব আছে? তার এই প্রশ্ন যথার্থ। হয়ত নেই। নেই বলে খোঁজারও দরকার নেই। যদি খোঁজারও দরকার না থাকে, তাহলে মহামান্য রাষ্ট্রপতিরই বা এত ঢাকঢোল পিটিয়ে আলোচনার দরকার কি ছিল? সেটা কি কেবল নামসর্বস্ব গোটা ত্রিশেক দলের স্বঘোষিত নেতাদের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ফটোসেশনের জন্যই?

আচ্ছা, নিরপেক্ষতার কথা না হয় বাদই থাক, আমরা বরং যোগ্যতা নিয়েই কথা বলি। প্রথমেই বলতে চাই সার্চ কমিটির প্রধান আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সম্পর্কে। বিচারক হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। এই যে সুনামের কথাটা বললাম এর ভিত্তি কি? ভিত্তি হলো- উনি যেসকল বিচার কাজ সম্পন্ন করেছেন, সেসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে- তাই। মানুষের সুনাম বা দুর্নাম তার কাজের উপর নির্ভর করেই হয়। তাহলে সার্চ কমিটির প্রধান হিসাবে তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করা যাবে? কোনো সন্দেহ নেই কমিটির ছয় জনের মধ্যে একমাত্র তাকেই মূল্যায়ন করা সহজ। কারণ আগের সার্চ কমিটিতেও উনি ছিলেন। কেবল ছিলেন না, সেখানেও প্রধান হিসাবে ছিলেন। সেই সার্চ কমিটি কাদেরকে খুঁজে বের করেছিলেন? কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরকে সার্চ করে বের করার মহান কর্মটি কিন্তু তার নেতৃত্বে সেই কমিটিই করেছিল। তাহলে এই খোঁজাখুঁজির কাজে তার অনেক যোগ্যতা আছে এমন কথা বলার সুযোগটা কোথায়? কমিটির আরও এক সদস্যের কথা তো আগেই বলেছি। উনি জানেনই না সার্চ কমিটি কে গঠন করছেন, কার করার কথা। সার্চ কমিটির গঠনপদ্ধতিটাও বড় অদ্ভুত। দু’জন বিচারক, দু’জন সরকারি কর্মকর্তা আর দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। গেলবারও ছিল একই ফরমেট। অনুসন্ধানকারী হিসাবে এই তিন পেশার বাইরে কি কেউ থাকতে পারে না? প্রতিবার একই পদ্ধতি হতে হবে কেন? ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলায় একটা কথা খুব উচ্চারিত হয়Ñ উইনিং কম্বিনেশনকে না ভাঙ্গা। এবারও কি সার্চ কমিটি গঠনের সময় সেই চিন্তাটা মাথায় ছিল?

দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক একটা মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে কমিটিতে এমন অন্তত দু’জন লোক আছেন যারা নির্বাচন কমিশনারের চেয়ে নিচের পদে কর্মরত। নিচের পদের লোককে কখনো তার চেয়ে উচ্চতর পদের মানুষকে খোঁজার দায়িত্ব দেওয়া যায় না। এই প্রশ্নের আইনগত জবাব কি, অথবা আদৌ কোনো জবাব আছে কি না জানি না। ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, এগুলো নাকি আইনের একেবারে প্রাথমিক বিষয়। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজেও একজন আইনজীবী ছিলেন। তাহলে এধরনের ভুল কি করে হতে পারলো, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশের রাজনীতি আসলে কিছু দিন পর পর একটা করে ইস্যু নিয়ে সক্রিয় থাকে। বেশির ভাগ সময়ই সেই সব ইস্যুর সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনোই সম্পর্ক থাকে না। এবারও তাই হয়েছে। কিছুদিন আগে চলছিল সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার ইস্যু। রাষ্ট্রপতি কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না, উদ্যোগ নিলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন কি না, এসব ছিল আলোচনার বিষয়। উনি আলোচনা করলেন। তখন কয়েকদিন এই ইস্যুটি বেশ চাঙ্গা ছিল। বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে এসে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেশ ঘটা করে বলতে থাকলেন, কার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কি আলাপ হয়েছে, তারা কে গিয়ে কি বলে এসেছেন- এই সব।

এখন সার্চ কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। এই কমিটি কতটা ভালো, কতটা মন্দ হলো- এসব নিয়ে এখন দিন কয়েক চলবে রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা। নানাজন নানা যুক্তি দেবেন, যুক্তির পর পাল্টা যুক্তিও আসবে। এই কমিটিকে বলা হয়েছে দশ দিনের মধ্যে তাদের প্রস্তাবিত কমিশনের নাম দেওয়ার জন্য। নাম দেওয়ার পর আবার চলবে তা নিয়ে ব্যবচ্ছেদ। রাষ্ট্রপতি সেই প্রস্তাবিত নামগুলো থেকে চূড়ান্ত কমিশন গঠন করবেন, একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের বেছে নেবেন। এরপর শুরু হবে আবার বিতর্ক, আবার আলোচনা। দেশের রাজনীতি এখন এই আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

আসলে এই যে সার্চ কমিটি, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনÑ এই সবকিছুরই চূড়ান্ত লক্ষ্য তো একটা সকলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। সেটা কি সম্ভব এই দেশে? কতটুকু কি সম্ভব সে আলোচনা তো করেছি এই লেখার শুরুর দিকেই।

আসলে আমাদের রয়েছে কিছু অভিযোগপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এরা কেবল অভিযোগ করে। প্রতিপক্ষের প্রাপ্তি নিয়ে অভিযোগ করে। নিজের হারানো নিয়ে অভিযোগ করে। স্থানীয় একাধিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিরোধীদল নির্বাচনের আগে থেকেই অভিযোগ শুরু করে। বলে- সরকারি দল প্রভাব বিস্তার করছে, প্রশাসনকে দিয়ে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে, বিরোধী দলের ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করছে, মানুষ ভোট দিলেও মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার সব কিছু ঠিক ঠাক করে রেখেছে। তারপর যে-ই না নির্বাচন হয়ে গেল, হয়ত অভিযোগের প্রতিফলনও ঘটলো, সরকারি দলের প্রার্থী জিতলো। বিরোধী দল তখন বলবেÑ কেমন আগেই তো বলেছিলাম। এবার মিললো তো? আর যদি বিরোধী দলের প্রার্থী জিতে যায়, তখন? তখন তারা বলবে, সরকার সব চেষ্টাই করেছে, কিন্তু ভোটের জোয়ারে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। এতসব ষড়যন্ত্র না করলে ভোটের ব্যবধান আরও বেশি হতো!

আবার এই মুদ্রার উল্টো দিকও আছে। কেউ একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে মনে করতে থাকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে কেন? ছলে-বলে-কৌশলে টিকে থাকতে হবে। বিরোধী মতকে ধূলিসাৎ করে দিতে হবে।

চরম এই দুই ধারার মধ্যে আমরা জনগণ আছি বড় বেকায়দায়। কবে এর অবসান হবে, অথবা আদৌ হবে কি না, কে জানে?

মাসুদ কামাল : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :