ডিজিটাল বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

কায়সার আল ফারুক
| আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৪৫ | প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:১৮

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সফট্ওয়্যার রপ্তানির ক্ষেত্রে বিগত দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। লাখ লাখ তরুণ আউটসোর্সিংয়ের মাঠে সক্রিয়। যার ফলে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে এই খাত থেকে। ব্যাংকসমূহ ডিজিটালাইজড হয়ে গেছে বহু আগেই, যার ফলে অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ইত্যাদি সুবিধা জনগণের দ্বারপ্রান্তে।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অনলাইন ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, যার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ তথ্য সেবা পাচ্ছে। ই-টেন্ডার, ই-জিপি ইত্যাদি ব্যবস্থা চালুর ফলে দুর্নীতির সুযোগ অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের যে ধারণা, তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের চেহারা আমূল বদলে যাবে এবং এক্ষেত্রে প্রচুর কাজ হচ্ছে এবং উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও সাধিত হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে ঝুঁকি এবং সমস্যা।

প্রথম ঝুঁকিটি হলো’ সরকারের শীর্ষ মহলের আগ্রহের কারণে এক শ্রেণির স্বঘোষিত তথ্যপ্রযুক্তিবিদের আবির্ভাব হয়েছে, যাদের এ বিষয়ে কোনো ডিগ্রি নেই। তাদেরকে কেউ চ্যালেঞ্জও করছে না, তারা একটার পর একটা চটকদার বিষয় হাজির করছে, যা একজন সাধারণ মানুষের কাছে চমৎকার মনে হবে কিন্তু কম্পিউটার বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিটি সেক্টরে এই শ্রেণি গজিয়ে উঠেছে। যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটছে। আমাদের বুঝতে হবে, ডাক্তারি করার জন্য যেমন মেডিকেল কলেজের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য যেমন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়, তেমনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্যও সার্টিফিকেট ও মেধা প্রয়োজন। সার্টিফিকেটবিহীন ডাক্তারকে যেমন প্রতারক হিসাবে র‌্যাব-পুলিশ ধরে, তেমনিভাবে এ ক্ষেত্রেও তার প্রয়োজনীয়তা আছে। কম্পিউটার নিয়ে কিছুদিন ঘাঁটাঘাঁটি করলে, লাল বোতাম, নীল বোতাম তৈরি করে চটক দেখানো সম্ভব হতে পারে কিন্তু তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং বলার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং আমাদের একটি নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে, প্রথমে যেটি করতে হবে, তা হলো একটি আইন, কারা কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারবে, আর কারা তৈরি করতে পারবে না। ডিগ্রিবিহীন স্বঘোষিত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সর্বরোগের ওষুধ প্রদানকারী স্বপ্নেপ্রাপ্ত চিকিৎসকের মতোই ধন্বন্তরী।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমার কাছে সমস্যা হিসেবে মনে হয়েছে তা হলো আইসিটি শিক্ষা। দেশের সব শিক্ষাবোর্ডে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আইসিটি শিক্ষা নামে একটি বিষয় চালু করা হয়েছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। আসুন এবার দেখি, কিভাবে এই ভালো উদ্যোগটিতে জল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা চাওয়া হয়, তা নিম্নরূপ : কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে এমএসসি অথবা পদার্থ বিজ্ঞান/পরিসংখ্যান অথবা যেকোনো বিষয়ে মাস্টার্স এবং কম্পিউটারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এখানে দেখার বিষয় হলো, যারা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তারা দেশে থাকেন না, বিদেশে চলে যান। যারা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন তারা কি এই মাস্টারির চাকরি করবেন? হাস্যকর বিষয় হলো আপনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করে বুয়েটের প্রভাষক হতে পারবেন কিন্তু ‘নাইল্যাকাডা’ কলেজের মাস্টারি করতে পারবেন না। আপনি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করে প্রধান প্রকৌশলী হতে পারবেন কিন্তু ¯œাতকোত্তর না থাকলে কলেজের মাস্টার হতে পারবেন না। সুতরাং যার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে, তিনি যেহেতু উন্মাদ নন, তাই তিনি লক্ষ টাকার চাকরি, বিদেশি নাগরিকত্ব ইত্যাদি ছেড়ে নাইল্যাকাডা কলেজের মাস্টারিতে আসবেন না। এর ফলে আইসিটির মাস্টারিতে ঢোকার জন্য আসলে আমরা সুযোগ করে দিচ্ছি তাদের, যাদের ডিগ্রি নেই। এদের দিয়ে কি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেধাবী কম্পিউটার প্রকৌশলীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব হবে? বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘বিলাই দিয়া মই দেওয়া যায় না’ অর্থাৎ কৃষি কাজে মাটি সমান করার জন্য মই দিতে হয়, তার জন্য দরকার হয় ষাঁড়, বিড়াল দিয়ে সে কাজ হয় না। কিন্তু আমরা বিড়াল দিয়ে হাল চাষ করার চেষ্টাই করে যাচ্ছি এবং তার জন্য আমরা খুব গর্বিত।

তৃতীয় যে বিষয়টি সংশোধন করা দরকার তা হলো বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি। কম্পিউটার সোসাইটি হলো একটি দেশের কম্পিউটার পেশাজীবীদের নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান। তারা বিভিন্ন কম্পিউটার পেশাজীবীকে সদস্য/ ফেলো হিসেবে ঘোষণা করে। কম্পিউটার সোসাইটির সহযোগী সদস্য না হলে আপনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইনগতভাবে স্বীকৃত কম্পিউটার পেশাজীবী নন। কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো হওয়ার যোগ্যতাটি যদি পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাই, ফেলো হতে গেলে ১২ বছর অথবা ১৫ বছর এ ধরনের একটি অভিজ্ঞতা লাগবে কম্পিউটার পেশাজীবী হিসেবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আপনার যদি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট ডিগ্রিও থাকে, কিন্তু আপনি যদি কম্পিউটারের কাজে ১২-১৫ বছর নিযুক্ত না থাকেন, তাহলে আপনি বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো হতে পারবেন না। ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে আপনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পারবেন, বুয়েটের অধ্যাপক হতে পারবেন কিন্তু বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো হতে পারবেন না। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি কি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান কি না? আবার আপনার যদি অভিজ্ঞতা থাকে, তা হোক কোন হেঁজিপেঁজি প্রতিষ্ঠানে আপনি ফেলো হতে পারবেন। তাহলে আমরা কি ইচ্ছা করে যোগ্যদের নেতৃত্বে আসার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছি না?

চতুর্থ যে বিষয়টি সংশোধন করা দরকার তা হলো, ইঞ্জিনিয়ার্স ইস্টিটিউশন বাংলাদেশ। এ প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে গেলে আপনার থাকতে হবে এই প্রতিষ্ঠানের সার্টিফাইড কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি। যার ফলে আপনি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে আইইবির সদস্য হতে পারবেন কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে আইইবির সদস্য হতে পারবেন না। অথচ তাদেরকে সরকার টাকা খরচ করে পড়িয়েছে, তারা মেধার যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি করে আপনি ইন্টেলে চাকরি করতে পারবেন, মাইক্রোসফটে চাকরি করতে পারবেন, গুগলে চাকরি করতে পারবেন, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের সদস্য, ফেলো সবই হতে পারবেন কিন্তু বাংলাদেশের আইইবির সদস্য হতে পারবেন না। আইইবি এতই দামি। আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আইইবির সদস্য হতে পারবেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করে এএমএআই করেও আইইবির সদস্য হতে পারবেন। তাহলে কি আমরা বলতে পারি না ইচ্ছাকৃতভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের আইইবিতে নেতৃত্বের পথে আসতে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে?

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এসব করা হচ্ছে? উত্তরটা বেশ সোজা। এমবিবিএস ডাক্তারদের যেমন ওঝা অপছন্দ করে, ব্যাপারটি সে রকম। ওঝারা যেমন বলেন, ডাক্তারের কাছে গেলে জিনে মাইন্ড করবে, বিষয়টা অনেকটা সে রকম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর, চাটুকারেরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রী তো আর ইঞ্জিনিয়ার নন। সুতরাং চাটুকারেরা বিভিন্ন লাল বোতাম আর নীল বোতামের ব্যবসা ফেদে বসেছে। তারা যতটুকু পারে, তাই বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সুবিধা নিচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটাই দেখি তা হলেই প্রমাণ পেয়ে যাব। বাংলাদেশ পুলিশে অফিসারদের মধ্যে কমপক্ষে ত্রিশজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আছেন। এদের মধ্যে বুয়েট পাস যেমন আছেন, তেমনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট করছেন এমন অফিসারও আছেন। কিন্তু রিজার্ভ চুরির তদন্তে আমরা যাকে দেখলাম তার কি ডিগ্রি আছে? তিনি কোথা থেকে কম্পিউটার শিখলেন? যারা হ্যাক করে, তারা অপরাধী হতে পারে, কিন্তু তারা উচ্চস্তরের কম্পিউটার প্রকৌশলী। আমাদের এই কর্মকর্তা, যার কোনো ডিগ্রি নেই, তিনি কি করে একদল উচ্চস্তরের মেধাবী পথভ্রষ্ট কম্পিউটার প্রকৌশলীকে পরাস্ত করবেন? পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে যে সব কর্মকর্তার পোস্টিং, তাদের কজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার? পুলিশের আইসিটির যিনি প্রধান তিনি একজন ব্যারিস্টার! যেখানে ত্রিশজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। ব্যারিস্টারি পড়ে যদি কম্পিউটারে প-িত হওয়া যায়, তাহলে তো আর কোনো কথা নেই। আমার কথাটি ফুরোলো নটেগাছটি মুরোলো। কিন্তু আসলে যায় কি?

পঞ্চম বিষয়টি হলো আইসিটি ক্যাডার। আমাদের ক্যাডার সার্ভিসে গরু-ছাগলের জন্যও ক্যাডার রয়েছে কিন্তু আইসিটির জন্য কোনো ক্যাডার সার্ভিস নেই। যার ফলে যোগ্য কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়াররা, যেহেতু তারা মেধাবী, হয় তারা কোনো প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে না হয় বিদেশে চলে যাচ্ছে। একথা তো সবাই আশা করি স্বীকার করবেন যে, উন্মাদ না হলে কেউ ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি পেয়ে নন ক্যাডারে যাবে না। সুতরাং আইসিটির কাজ করার জন্য রাষ্ট্র সেরা ইঞ্জিনিয়ারদের পাচ্ছে না। তাই অতি দ্রুত বিসিএস পরীক্ষায় আইসিটি ক্যাডার করা প্রয়োজন। তা না হলে নিম্নমানের চটকদার সফটওয়্যারে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে, যা পরবর্তী সময়ে নকশাগত/নিরাপত্তাগত/ইঞ্জিনিয়ারের যোগ্যতাগত ত্রুটির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার মতো রাষ্ট্রকে ভোগাবে। বুয়েটের অধ্যাপকগণ কিন্তু ঠিকই রিজার্ভ চুরির সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। সুতরাং আমাদের নীতি- নির্ধারকদের এখনই চাটুকার বিড়াল দিয়ে মই দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে হবে এবং ভণ্ড ওঝা/ স্বপ্নেপ্রাপ্ত চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে দেশের আইসিটি খাতকে মুক্ত করতে হবে, কারণ আইসিটি বিজ্ঞান, এখানে স্বপ্নের স্থান নেই।

কায়সার আল ফারুক : কবি ও তথ্যপ্রযুক্তি গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :