কৈশোর

ভয়ংকর হয়ে ওঠাদের সুপথে আনতে হবে

সৈয়দ শিশির
 | প্রকাশিত : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৪৯

সমাজ যেন দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। নতুন নতুন সমস্যা হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। তেমনি এক সমস্যা- হঠাৎ করে ভয়ংকর হয়ে উঠছে ‘বখে যাওয়া কিশোর অপরাধীরা’। অবশ্য হঠাৎ করে বলা ঠিক নয়। বলা যায়, এত দিন বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসেনি। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর বিষয়টি সবার সামনে আসে। বখে যাওয়া এসব কিশোর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়ছে। হত্যাকা- ঘটিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে বীরদর্পে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। স্কুল-কলেজের মেয়েদের দেখলেই নানাভাবে হয়রানি করছে। তাদের বিরুদ্ধে এলাকার লোকজন কোনো প্রতিবাদ করার সাহস রাখে না। থানা পুলিশেরও যেন এ বিষয়ে খুব একটা নজরদারি নেই, যে কারণে তারা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

গণমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক খবরে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নানা নামে গড়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীদের বিশেষ গ্রুপ। এসব গ্রুপের সদস্যদের বেশিরভাগই টিনএজার বা ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পাশাপাশি তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। ৬ জানুয়ারি উত্তরায় কিশোর গ্রুপের হাতে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্য ও স্কুলছাত্র আদনান কবির নিহত হয়েছে। ৩ জানুয়ারি রাতে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন বাবুলের ভাতিজা দীপু সিকদারকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে ডিসকো বয়েজ গ্রুপ এবং নাইন স্টার গ্রুপ জড়িত। গত মাসে উত্তরার ৯/এ নম্বর রোডে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় ডিসকো গ্রুপের ছোঁন খান ও সাকিব নাইন স্টার গ্রুপের তালাচাবি রাজুর ওপর হামলা চালিয়ে আহত করে। ওই ঘটনায় পুলিশ সাবেক জেলা জজের ছেলে নাফিস মোহাম্মদ আলম নামের এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে। পরে আলম মুক্তি পায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা কি শুধু উত্তরায়ই ঘটছে? অবশ্যই না, বরং বলা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এসব গ্যাং সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে। এদের প্রতিটি গ্রুপে একজন দলনেতা থাকে। যে প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বেশি পারদর্শী তাকে দেওয়া হয় গ্রুপের নেতৃত্ব। এসব খবরে আমরা যা পাই তা একটা প্রজন্মের নষ্ট হয়ে যাওয়া একাংশের খ- চিত্র। এ চিত্র যদি বদলানো না যায়, তা হলে ভবিষ্যতে সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের বাসোপযোগী থাকবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

গত ১০ বছরে রাজধানীর আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই কিশোর অপরাধীদের হাতে ঘটেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা তথ্যটি আমাদের আরও বেশি ভাবিয়ে তোলে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বয়সে নিজেকে গড়ে তোলা ও পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী? আসলে কিশোর অপরাধের জন্য বহুবিধ কারণ দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট কারণে অপরাধ সৃষ্টি হয় না। এক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়Ñইন্টারনেট, ফেসবুক, টেলিভিশন, বিদেশি অনুষ্ঠান দেখে আমরা ভিনদেশি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছি। বিভিন্ন ভয়ংকর ভিডিও গেমস এবং অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র কিশোরদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলছে। স্কুলগুলো অতিমাত্রার বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না। কিশোরদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি হলেও তাদের তা করানো হচ্ছে না। তরুণরা যত দ্রুত টেকনোলজি গ্রহণ করছে, তত দ্রুত মূল্যবোধ গ্রহণ করছে না। তাছাড়া টেকনোলজি ব্যবহারকালে তারা বুঝতে পারছে না দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু গ্রহণ করা উচিত। ফলে হিতে বিপরীত ঘটছে।

ঘটে যাওয়া বিপরীতের আড়ালে আছে অনেক অজানা বিষয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কিশোর অপরাধীদের মধ্যে বেশিরভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সদস্য। তারা পরিবার থেকে বখে গিয়ে অপরাধ কর্মকা- চালাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তাদের পুলিশ আটক করলেও তদবির করে ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে বলেও শোনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ছাড়িয়ে নেওয়াদের অভিভাবকেরা কি তাদের সন্তানদের সুপথে ফেরাতে পারছেন বা আদৌ ফেরানোর চেষ্টা করছেন? এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। আর তা হলো- কোনো চক্র কিশোর অপরাধীদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে না তো? সে চক্রটিই কিশোর অপরাধীদের অস্ত্রের জোগানদাতা নির্ধারণ করছে না তো? কারণ বখে যাওয়া কিশোররা যে এত সহজে অস্ত্র পাওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশে তো অস্ত্র এখনো চকোলেটের মতো সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। পিলে চমকে ওঠে যখন শুনি, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে ওরা ব্যবসায়ী, ফুটপাত ও হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটছে হত্যাকা-। এলাকার আধিপত্য ও চাঁদা আদায় করা নিয়ে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর কদমতলীতে বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র রিয়াদুল, মেহেদি হাসান ও আহাদকে ছুরি মেরে আহত করা হয়। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর কামরাঙ্গীরচরে দুই কিশোরের হাতে খুন হয় আলিফ নামের এক কিশোর। ৪ ডিসেম্বর রাতে লালবাগে রবিন নামের এক কিশোরের ছুরিকাঘাতে আবু সালেহ রাব্বী নামের আরেক কিশোর খুন হয়। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা তাদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে? যদি এ ভাবনা সঠিক হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোন পথে?

কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুদের ৯০ শতাংশ মাদকসেবী। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনের মতো মরণনেশায় আসক্ত তারা। আর এ নেশার খরচ জোগাতেই তারা যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। অপরাধ জগৎ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাদের পক্ষে তা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। তারা শিশু-কিশোরদের দিয়ে খুন-রাহাজানির মতো বড় অপরাধ করিয়ে থাকে। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্করা আইনগতভাবে কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকে এবং পুলিশও তাদের তেমন একটা সন্দেহ করে না ও নজরদারির মধ্যে রাখে না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সমাজ ও পরিবার এখন পার করছে এক অস্থির সময়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের অভাবে পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তি বা অভিভাবকদের ওপর অস্বাভাবিক চাপ, সর্বোপরি বিশ্বায়নের ধাক্কায় পরিবারের বন্ধন, মূল্যবোধ সব কিছু যেন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ইচ্ছে করলেও পরিবারে সন্তানদের যথাযথ দেখাশোনা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। দিন দিন বাড়ছে ব্রোকেন ফ্যামিলির সংখ্যা। এসব ফ্যামিলিতে বেড়ে ওঠা সন্তানরা পাচ্ছে না বাবা-মায়ের পরিচর্যা। এর একটি নীতিবাচক প্রভাব পড়ছে সন্তানদের সামাজিকীকরণে। এ কথাও স্বীকার করতে হবে, অনেক সময় জীবিকা অর্জনের জন্য নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। কিন্তু তাদের কি সুপথে ফেরানো সম্ভব নয়? সম্ভব। যদি সঠিক পদ্ধতি মেনে সেই চেষ্টা করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে সুপথে ফেরাতে হলে অভিভাবকদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। সন্তানের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। কারণ বিনা বাতাসে যে নদীর জল নড়ে না। তেমনি এক্ষেত্রেও রয়েছে নানা কারণ। যেমন, মানুষের দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য অপরাধপ্রবণতার জন্য দায়ী। ত্রুটিপূর্ণ দৈহিক গঠন, স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটি প্রভৃতি শিশু-কিশোরদের মাঝে হীনম্মন্যতাবোধ এবং অস্বাভাবিক আচরণের সৃষ্টি করে বলে সে পরিবেশের সঙ্গে স্বাভাবিক উপযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয় এবং একপর্যায়ে সে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। আবার পূর্বপুরুষের কেউ অপরাধী হলেও তার প্রজন্ম অপরাধী হতে পারে। মানসিক অক্ষমতা বা দোষত্রুটির কারণেও কোনো শিশু-কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, পারিবারিক দাম্পত্য-কলহ, পিতা-মাতার অতি উচ্চাশা, অতিরিক্ত আদর ও স্নেহ, অতিশাসন, অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ, নিরাপত্তাবোধের অভাবেও তাদের মধ্যে কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণ যে আরও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দারিদ্র্য, বিপর্যস্ত গৃহ, অস্বাস্থ্যকর বিদ্যালয় প্রথা। সেই সঙ্গে সামাজিক কারণ তো আছেই।

আসলে কি, কিশোর বয়সটাই বেপরোয়া ও আগ্রাসী একটা বয়স। কৌতূহলের বশে বা অজ্ঞাতসারেই কিশোর বয়সীদের পা পড়ে যেতে পারে অন্ধকার জগতে। তাই কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে এবং কেউ তাদের অসৎকাজে ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। গোটা সমাজেই শিশু-কিশোরদের সুস্থ-সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য সবার আগে পরিবার তথা বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করে, কার সঙ্গে সময় কাটায়- এসব খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানদের অযৌক্তিক আবদার পূরণ করার আগে ভাবতে হবে। সন্তানদের ছোটবেলা থেকে যদি স্নেহ আদর দিয়ে ভালোভাবে শিশুর চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখা হয়, তাহলে শিশু-কিশোর অপরাধীর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।

মনে রাখা দরকার, জন্মগতভাবে কেউ অপরাধী হয় না বা অপরাধী হয়েই কোনো শিশু ভূমিষ্ঠ হয় না। বরং জন্মের পর সময়ের ব্যবধানে সময়ে পরিবেশ, পরিস্থিতিসহ নানা কারণে সে অপরাধী হয়ে ওঠে। তাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশু-কিশোরদের অপরাধী বিচারের ক্ষেত্রে তাদের আলাদা করে বিচারের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। কিন্তু এক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, অপরাধী শিশু-কিশোরদের শিশু-কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে বয়স বাড়িয়ে জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে। এতে তারা সংশোধিত না হয়ে আরো বড় ধরনের অপরাধী হয়ে উঠছে বলে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের অবশ্যই সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। কারাগারগুলোকে সংস্কার করে অন্তত শিশু-কিশোর অপরাধীদের জন্য ‘সংশোধনাগার’ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা রোধে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার অনষঙ্গ যুক্ত করতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষার বিষয়টির দিকেও জোর দিতে হবে। কারণ পরিবার হচ্ছে মানুষ গড়ার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের উদ্যোগেই ভয়ংকর হয়ে ওঠাদের সুপথে আনতে হবে।

সৈয়দ শিশির: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :