নতুন যুগে বাংলাদেশ

লে. কমান্ডার এ এম আব্দুল্লাহ (অব.)
 | প্রকাশিত : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৫৬

আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। সামগ্রিক পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তার অবস্থানকে ভালোভাবেই জানান দিতে সক্ষম হচ্ছে। এই পরিবর্তন হঠাৎ কোনো পরিস্থিতি থেকে নয়। বরং সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা অর্জনের সাফল্যই তাকে এ সম্মান এনে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে এক ধরনের অর্থনৈতিক ভারসাম্যমূলক বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।

জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারন ছিল এক ঐতিহাসিক বিজয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হওয়ার পর সত্যিই এটা বোঝানো খুব কঠিন যে, এ সাফল্যের পিছনে কত কাজ করতে হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা এই বিজয়ের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করছে। পররাষ্ট্রনীতির একটা বড় ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে, তবে তার নেপথ্যে নৌবাহিনী এবং এর কর্মকর্তাদের পরিশ্রম, মেধা ও দীর্ঘদিনের পেশাদারিত্বেও অবদান সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন রকম তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও সেগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন ছিল এ বিজয়ের নেপথ্য কারিগর। সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধের ফলে আমাদের নিজেস্ব জলসীমায় অধিকার না থাকার যে বেদনা তার বাস্তবতা বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে প্রতিদিন অনুভব করতে হতো। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর কার্যকরী ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর বাংলাদেশের নৌবাহিনীর জন্য টহল এলাকা পূর্বের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ঐসব তেল-গ্যাসসহ সমুদ্র সম্পদ আহরণে আর কোনো বাধা না থাকায় সম্পূর্ণ সমুদ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং নিরাপত্তা বিধান করাও নৌবাহিনীর কাঁধে অর্পিত হয়েছে। সেই লক্ষ্যে নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ অতীব জরুরি। ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার কথাটা তিন দশক আগে থেকে বলা হলেও ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রকৃত পক্ষে একটি ভাসমান প্লাটফর্ম ছাড়া অন্য কোনো মাত্রিকতা লাভ করতে পারেনি। বর্তমানে সরকার ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে দুটি হেলিকপ্টার ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১০ সালে হেলিকপ্টার সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সত্যি সত্যি একমাত্রিক নৌবাহিনী থেকে দ্বিমাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়।

সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী দু বছরের মধ্যেই আরো সংযোজিত হয় মেরিটাইম পেট্রল এয়ার ক্রাফট (MPA)। এই সংযোজন নৌবাহিনীর সার্চ এবং রেসকিউ অপারেশনের গতিকে অনেকখানি ত্বরান্বিত করে। কিন্তু পরিপূর্ণ একটি নৌবাহিনীর জন্য পানির নিচেও অপারেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে গত মাসে গণচীনের তৈরি দুটি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে। এর ফলে শুধুমাত্র নৌবাহিনী নয় বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে এক নতুন যুগে। আমাদের মতো গরিব দেশে যেকোনো অর্থব্যয় বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তবে শক্তিশালী নৌবাহিনী শুধুমাত্র সমুদ্রে সীমায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশকে অন্য মাত্রিকতায় স্থান করে দিতে পারে। সংবেদনশীলতার কারণে কিছু কিছু বিষয় হয়ত আলোচনা করা সম্ভব নয়, শুধুমাত্র পারিপার্র্শি¦ক ঘটনাসমূহ থেকে সেই বাাস্তবতা উপলদ্ধি করা সম্ভব।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতের কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেন। আঞ্চলিক প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই এই সফর অনেক গুরুত্ব বহন করে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার দুদেশের নিরাপত্তা বন্ধন বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে নৌ-সহযোগিতা বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। International Maritime Boundary Line (IMBL)-এ বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বিত টহল শুরু করতে চায় ভারত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় মনোহর পারিকার তার সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তিন বাহিনীর প্রধান ছাড়াও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। স্থল সীমানার নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুদেশই সমন্বিত পদক্ষেপের উপর সবসময় গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বর্তমানে ভারত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য একমাত্র উম্মুক্ত এলাকা সমুদ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমা টহলে তাই সে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। সাবমেরিন অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হওয়ায় তা অন্যদের জন্য আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। নিজেদের সমুদ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ রক্ষার্থে নৌবাহিনী অনেকটা সক্ষমতা অর্জন করেছে।

নৌবাহিনীর এই সক্ষমতা বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান তৈরিতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে পরাশক্তিসমূহ। বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পূর্ব ও মধ্য এশিয়ায় চীনের আধিপত্যের বিপরীতে ইন্দো-মার্কিন সম্পর্ক আরো জোরদার হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে Logistics Exchange Memorandam of Agreement (LFMOA) চুক্তি তারই প্রমাণ। সামরিক বিশেষজ্ঞরা এটাকে মূলত চীনের আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করছেন। কারণ এই চুক্তির ফলে উভয় দেশ একে অন্যের জন্য রসদ, যন্ত্রপাতি, জ্বালানি ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করতে পারবে। শুধু তাই নয়, দুই দেশের সামরিক বাহিনী একে অন্যের ঘাঁটি ব্যবহার করে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।

দেশ দুটির মধ্যে আরো দুটি চুক্তি চূড়ান্ত স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। চুক্তি দুটি হলো Communication Interoperability and Security Memorandum of Agreement (CISMOA) and Basic Exchange and Cooperation Agreement for Geo-Spatial Cooperation (BECA). এত এত সব চুক্তির ভিড়ে এই মুহূর্তের খবর হলো, আমেরিকা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মতো লজিস্টিক চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে তারা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। একদিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফর ও প্রস্তাব, অন্যদিকে একটি সামরিক চুক্তির জন্য আমেরিকার আগ্রহ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। দক্ষিণ চীন সাগরে জাপান ও চীনের বিরোধ মূলত চীন ও মার্কিন আধিপত্যের বহিঃপ্রকাশ। ঠিক তেমনি বঙ্গোপসাগর ঘিরে এর নিয়ন্ত্রণ নিতে নতুন হিসাব-নিকাশে লিপ্ত রয়েছে চীন ও আমেরিকা।

এ অঞ্চলে ইন্দো-মার্কিন প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে চীনের অংশগ্রহণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চীন আমেরিকার এই দ্বৈরথে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার পররাষ্ট্র এবং সামরিক নীতিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ, এখানে বিভিন্ন সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ১৯৯৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শান্তি বাহিনীর মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি করে দীর্ঘদিনের সমস্যাকে সমাধান করেছেন। শান্তিপূর্ণ সমাধান করা না গেলে শ্রীলংকার মতো রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারতো।

ছিটমহল সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে ভারত পাকিস্তানের মতো যুদ্ধাবস্থা তৈরি হতে পারত। তার চেয়ে বড় কথা ছিটমহল সমস্যা সমাধান করে ৬৮ বছর ধরে কয়েক প্রজন্মের হাজার হাজার মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টকে চিরতরে লাঘব করা সম্ভব হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নিরসন মূলত বাংলাদেশের বিজয় হিসাবে প্রচার লাভ করার ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে অন্য মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই অবস্থান তৈরিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে প্রধান প্রধান সমস্যা নিরসনের পর দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে বড় বড় প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন সমুদ্র বন্দর করা হয়েছে, দ্বীপ ও সমুদ্র উপকূলে বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।

পদ্মা সেতু চালু করার পর গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ পরবর্তী মেগা প্রজেক্ট হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল ও সমুদ্রে এসব বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ ও সুরক্ষার জন্য আগে থেকেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। সেই বাস্তবতার আলোকে নিজেদের নিরাপত্তার সঙ্গে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী সময়ের প্রয়োজনীয়তা দাবিতে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে পরাশক্তিসমূহের একে অন্যের বিপরীত জোট গঠন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হলেও সেদিকে দৃষ্টিপাত করার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ধরনের চুক্তি পূর্বেও বহু হয়েছে, বর্তমানেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কিভাবে তার শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখে নিজে লাভবান হতে পারে সেটাই মুখ্য বিবেচ্য বিষয়।

বাংলাদেশ যেহেতু কারো সঙ্গে বৈরিতায় বিশ্বাস করে না, এ কারণে তার উচিত হবে না এই মুহূর্তে কোনো সামরিক জোট গঠন করে অন্য পরাশক্তির বিরাগভাজন হওয়া। বরং নিজের সমর্থকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বৃদ্ধি করতে পারলে তা বাংলাদেশকে আরো শক্ত অবস্থান তৈরিতে সাহায্য করবে। সমুদ্রসীমা বিরোধের কারণে ইতিপূর্বে বহুবার সমুদ্রসীমায় অযাচিতভাবে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। নৌবাহিনীর দৃঢ় নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের কারণে লোকচক্ষুর অগোচরে বাংলাদেশের মানুষের গর্ব করার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। পররাষ্ট্রনীতি ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার স্বার্থে সেসব ঘটনা প্রচার করা থেকে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ। সমুদ্র সীমার বিরোধ নিরসন ও শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা বাংলাদেশকে নতুন এক যুগে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।

এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে পরাশক্তির প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ সক্ষম হবে। বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরাশক্তিসমূহ অনেক ক্ষেত্রে ছোট, দুর্বল ও দরিদ্র দেশসমূহের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে থাকে। বর্তমান সরকার চট্টগ্রামকে হংকংয়ের আদলে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর অপরিহার্য। পরাশক্তির প্রভাব বলয়ের বাইরে নিজেদের অধিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে তৃতীয় কোনো পক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা গেলে বাংলাদেশের জন্য তা অধিক লাভজনক হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো কাজ এগিয়ে যাওয়ায় নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। সেই আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এটা শুধু অর্থনীতি নয় কূটনীতির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিককালের রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু বাংলাদেশের জন্য উভয় সংকট তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে না দিয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল বেশি কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমার সরকারকে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশ অত্যন্ত সংগত কারণেই সে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনে তা সহায়ক হবে। আর প্রভাব বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অত্র অঞ্চলে শক্তিশালী নৌবাহিনীর উপস্থিতি প্রয়োজন। সাবমেরিন যুগে প্রবেশের মাধ্যমে নৌবাহিনী সেই অগ্রযাত্রায় শামিল হতে পেরেছে। তবে এ গতিকে বাড়াতে হলে পুরনো যুদ্ধজাহাজগুলোর পরিবর্তে আধুনিক যুদ্ধজাহাজ সংযোজন করা প্রয়োজন। ছোট আকৃতির যুদ্ধজাহাজ দেশে তৈরি করা হলেও বড় যুদ্ধ জাহাজ তৈরি এ মুহূর্তে সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে সমুদ্র এলাকার জরিপ কার্যের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সার্ভেশিপের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে।

তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে শুধুমাত্র নিরাপত্তা নয়, কারিগরি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৌবাহিনীর অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এসব সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেক বেশি ত্বরান্বিত হতো। একই সঙ্গে ভারত, আমেরিকা, চীনের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে প্রতিটি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। যেহেতু জোট গঠন অনেক ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়, তাই সেদিকে না গিয়ে এ মুহূর্তে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করাটা যুক্তিযুক্ত। শক্তিশালী অবস্থানই অন্যের মধ্যে নিজের সম্মানকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করে। সে ইঙ্গিত আঞ্চলিক রাজনীতিতে শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। তবে বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতিতে কতটা লাভবান হতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লে. কমান্ডার এ এম আব্দুল্লাহ (অব.) : সাবেক সামরিক কর্মকর্তা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :