সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্ব ও মানুষের ক্ষমতায়ন

মুহম্মদ মাহবুব আলী
 | প্রকাশিত : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১০:৩৬

একটি দেশের উন্নয়নের জন্যে বিশেষত দারিদ্র থেকে মুক্তির জন্য বর্তমান একবিংশ শতকের দ্বিতীয় যুগে সামাজিক যোগাযোগ যথেষ্ট মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি অলিখিতভাবে হাজার বছর ধরে কেবল বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বিভিন্ন দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্রে যারা দেশে দেশে কালে কালে যুক্ত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বটি বহুল প্রচলিত একটি ব্যাপার। সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের ক্ষমতায়ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই ঘটে থাকে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর যখন সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তখন তা মোট জাতীয় উৎপাদনশীলতায় সংযুক্তি ঘটে। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় যখন সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বটি কাজ করে তখন এটি মানুষের অস্তিত্ব ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসাবে হত দরিদ্র ও দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের কারণেই বর্তমান সরকার আর্থিক অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মকা- পরিচালনা করছেন যার মাধ্যমে মানুষ সঞ্চয় বিনিয়োগে উৎসাহী হয় এবং ভোগ প্রবণতায় তার দক্ষতা ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে থাকে।

পরিবর্তিত বিশ্বের কারণে প্রাচীনকাল থেকে অলিখিতভাবে চলে আসা সামাজিক গণমাধ্যম/ইন্টারনেট/মোবাইল সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে আর্থিক পরিবেশ জানার জন্যে ইন্টারনেট/ মোবাইল ব্যবস্থাপনা অতি দ্রুত কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের একটি গ্রামের কথাই ধরা যাক যেখানে পূর্বে যোগাযোগে অনেক বিলম্বিত হতো, এখন মুহূর্তের মধ্যে মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পলকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। গ্রামীণ একজন কৃষক মোবাইলের কল্যাণে শহরে ফোন করে জানতে পারে কি দরে তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

অবশ্য সরবরাহজনিত ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ কৃষক ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হচ্ছে। মাঝখান থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করছে। তারপরও ৩০/৪০ বছর আগে কৃষক, মৎস্যজীবী সহ অন্যান্য পেশার লোকদের আগের মত ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে অবশ্যই বন্টন ব্যবস্থাকে সুষম ও জনমুখী করার প্রয়োজন রয়েছে। নচেৎ এ ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটিসমূহ চিহ্ণিত হবে প্রকারান্তরে তা বাজার ব্যবস্থাপনার সকল ত্রুটি বিচ্যুতিকে দূর করবে না। বরং তথ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা বহাল থাকবে। এ জন্যে অবশ্য সরকার মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করার প্রয়াসও গ্রহণ করেছেন এবং সরাসরি পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছেন।

ধীরে ধীরে গ্রামীণ অর্থনীতি যত শক্তিশালী হচ্ছে তত কিন্তু নানামুখী পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদানসমূহ। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা কাজ করে থাকে।

লেইক এবং হাকফেলট (১৯৯৮) সালে মন্তব্য করেছেন যে, সামাজিক পুঁজি যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে যা নাগরিকদের মধ্যে একটি সম্পর্ক উন্নয়ন করে থাকে, সামাজিক পুঁজি বৃদ্ধি করে এবং কৌশল হিসাবে রাজনৈতিক উপায় ও প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে সাফল্য দিতে সক্ষম হয়। যেহেতু জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে পেট ভাতে রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী সেহেতু সামাজিক উন্নয়ন, জীবন দর্শনে, মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, নীতিজ্ঞানতা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়াসের ক্ষেত্রে ব্যষ্টিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করছেনÑ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সুসংগত করার মাধ্যমে।

রাজনৈতিক দর্শনই বর্তমানে সামাজিক পুঁজি গড়ে উঠতে সহায়তা প্রদান করছে যা জনমানুষের বহুমুখী দরিদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হচ্ছে। পরিবেশ অবশ্যই সামাজিক উননয়ন, ন্যায়বিচার ও সুষম বন্টন ব্যবস্থার উপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের সংখ্যা যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে তা বস্তুত সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের পাশাপাশি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পুর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আশার কথা সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে আট ধাপ অবস্থান উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। কমিউনিস্ট ব্যাংকিং তৃণমূল পর্যায়ে করা গেলে গতিময়তা পাবে।

সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয় সামাজিক বুদ্ধিমত্তা। রিগো (২০১৪) মন্তব্য করেছেন যে, সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণ চলার মত গুণ এবং সমাজের অন্যদের সাথে একীভূতভাবে কর্মসম্পাদন করার ক্ষমতা বোঝার। রিগোর এ বক্তব্য অতিশয় তাৎপর্যম-িত। আমরা যদি মানুষী সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখব যে, অগ্রসারমান জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে সামাজিক বুদ্ধিমত্তা একটি অন্যতম উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আসলে যুথবদ্ধভাবে সমাজে বাস করতে গেলে সামাজিক বুদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন হয় যা সমাজের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে থাকে।

লিডবিরটর ১৯৯৭ সালে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সামাজিক উদ্যোক্তা উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। তার এ বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য। যখন কোন উদ্ভাবনই ঘটে থাকে তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এ উদ্ভাবনী শক্তিকে মানুষ যদি তার ও সমাজের উন্নয়ন কর্মকা-ে পরিচালিত করে তবে তা দেশ ও জাতির জন্যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আবার খারাপ কাজে ব্যবহার করলে তা কিন্তু হিত সাধনের বিপরীত ভিন্নমুখীতা দেয়।

আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি পারমানবিক বোমা উদ্ভাবনের পর নাগাসাকি ও হিরোশিমাকে তা মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আবার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে সামাজিক উদ্যোক্তারা সমাজে দক্ষতা, কার্যকারিতার মাধ্যমে যোগ মূল্য সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়ে থাকে।

এ দেশে আবহমানকাল থেকে সামাজিক ব্যবসা প্রচলিত ছিল যার মূল ভিত্তি ভূমি ছিল সামাজিক পুঁজি, বিনিয়োগ ও শ্রম। তবে এ ড. মুহম্মদ ইউনূস প্রথমদিকে এটি নিজের উদ্ভাবন বলে দাবি করলেও এক্ষণে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলেছেন এটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে কাজ করছেন। মনে পড়ে ২০১৩ সালে যখন আমি তৃতীয় মাত্রায় বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম তখন এদেশের একজন অর্থনীতিবিদ বিষয়টির প্রচ- বিরোধিতা করেছিলেন।

শেখ হাসিনা বর্তমানে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের উপর জোর দিচ্ছেন। এটি সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করে সামাজিক পুঁজিতে রূপান্তর ও পাশাপাশি মানব পুঁজি এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন, কর্মদক্ষতা ও কার্যকারিতা পরিদর্শন করা সম্ভব হয়।

প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় ক্ষমতায়ন, ক্রয়ক্ষমতা এবং সামাজিক উদ্যোক্তা একত্রিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনাকে একটি দেশের উন্নয়নে কাজ করে অতি দারিদ্র্য কিংবা দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র থেকে মুক্তি দেয়। এ ক্ষেত্রে মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অথবা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসাবে পালন করে থাকে।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আবহমানকাল থেকে চাল সামাজিক যোগাযোগ ও জনগণের ক্ষমাতয়নের একটি তত্ত্ব বা মডেল সচিত্র নিম্নে দেখানো হলো:

চিত্র নং : ১ এ দেখা যায় যে পরিবেশ ও বেশ গুরুত্ব বহন করে থাকে। উপরোক্ত মডেলটি দেশে বিদেশে বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। টাকার অভাবে কেবল খুলনায় দুটো গ্রামে কেবর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্ব জনগণের ক্ষমতায়নে কাজ করে থাকে। এটি ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করার জন্যে সরকার ও বেসরকারি খাত এবং বিদেশি গবেষকদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। পাশাপাশি আশা করা সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে মানব উন্নয়নে ও আত্মমর্যাদাশীল করে তুলতে হলে আর্থিক অন্তর্ভূক্তিকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকার প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। উদ্যোক্তাকে অবশ্যই সামাজিক উন্নয়নে জনগণের প্রয়োজনের নিরিখে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।

লেখক অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ।

ই-মেইল : [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :