শিক্ষার্থীর আক্রান্ত পিঠ

কাজী আনিস
 | প্রকাশিত : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:২৯

নেতা হাসছেন। আর হাঁটছেন। পথ তার নিষ্পাপ শিশুর পিঠ। এ নেতা চাঁদপুরের এক আওয়ামী লীগ নেতা। উপজেলা চেয়ারম্যান। তাকে নামানোর জন্য আরেক কোমলমতি শিক্ষার্থী পিঠ বাঁকা করে আছে। সেখানে পা দিয়ে নামবেন নেতা।

স্থানীয় একটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়েছেন এ নেতা। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পিঠকে বানানো হয়েছে পদ্মা সেতু। আর সেই সেতুতে হাঁটছেন নেতা। ভাবছি, কতটা বিকৃত, নোংরা, অসভ্য আর হিংস্র মস্তিষ্ক হলে এমন আইডিয়া বের হয়ে আসে। কতটা আহাম্মক হতে পারে ওই স্কুলের শিক্ষক- কর্মকর্তারা।

নেতার এহেন কাজে সামাজিক মাধ্যমজুড়ে প্রতিবাদ উঠেছে। আমিও প্রতিবাদী এক লেখা লিখে ভাবতে বসেছি। ভাবছি, শিক্ষার্থীর পিঠে নেতার পা যেন এক দৃশ্যমান প্রতীক। নেতার পা দৃশ্যমান। কিন্তু অদৃশ্য অনেক পায়ের আঘাত বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর পিঠে-আমরা দেখি না। এ নোংরা পা কখনও ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণে, কখনও বইয়ের আধিক্যে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষার্থীদের মাঝেই জাতির ভবিষ্যৎ। এ শিক্ষার্থীদের পিঠে নোংরা আঘাত সেই মেরুদণ্ডকেই ভেঙে দেয়ার সচেতন, অবচেতন এবং অসেচতন হামলা।

প্রতিদিন সকালে মোহাম্মদপুর এলাকায় দেখি, কয়েকশ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ব্যাগের বোঝা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ব্যাগ নয়, যেন নোংরা এক ভারি পা। তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশু। শিশু কুঁজো হয়ে যায়, কষ্ট পায়, কাঁদে; কিন্তু বাহাদুরদের কানে এ কান্নার শব্দ পৌঁছে না। চোখে পড়ে না। এ বাহাদুরদের বাচ্চাদের ব্যাগ বহন করে গাড়ি, চকচকে গাড়ি। তাই আমার মতো গরিবের বাচ্চাদের ব্যাগের বোঝা বহন গাড়ির কালো কাচের ভেতর দিয়ে তাদের কাছে অনেক সুন্দর লাগে। অথচ তাদের বাচ্চারা বিদেশ গিয়ে বিদেশিদের খেদমত করবে। নষ্টটা করে দেয়া হয় আমার, আপনার বাচ্চাদের। পিঠ বাঁকা করে দিয়ে, মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে। ভেঙে পড়বে তো আমার মাটি, আমার দেশ, বাংলাদেশ।

আমিও এক বাচ্চার বাবা। আমার ভাবতে কষ্ট হয়, এ দেশের স্কুলে আমার বাচ্চাটা পড়বে। যেখানে ইতিহাস দুই ধরনের, যেখানে কবিতা কেটে দেয়া হয়, যেখানে ভুল বাক্য আর ভুল তথ্যে বই পড়ানো হয়। ভাবতে কষ্ট হয়, বড় হয়ে আমার বাচ্চাটা বইমেলায় যাবে। এমন বই সে পড়বে, যা তাকে ভাবায় না, চিন্তা করায় না। সৃষ্টিতে উৎসাহ দেয় না। সে দেখবে কেবল কে কাকে কত তোষামোদী করেছে, তেল মেরেছে-এমন সব বই। আমার বাচ্চার মস্তিষ্ক হয়ে পড়বে অলস, তোষামোদী কালচার দেখতে দেখতে তার মেরুদণ্ড হয়ে পড়বে তেলে ভাজা মচমচে কোনো কিছুর মতো, শক্ত নয়, কঠিন নয়। সত্যিই আমি ভাবতেই শিউরে উঠি। মনে মনে ক্ষমা চাই, আমার কারণে তাকে এ দেশে বাধ্য হয়ে জন্ম নিতে হয়েছে।

পদ্মা সেতুর সার্কাস দেখাতে গিয়ে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সেতুটিকে ভেঙে দিচ্ছেন কেন? আমাদের শিশুদের একেকটি পিঠ একেকটি সেতু। পদ্মা সেতু দিয়ে নদী পাড় হওয়া যায়, আর আমার আপনার বাচ্চার পিঠ শক্ত হলে, মজবুত হলে উন্নত দেশ হওয়ার জন্য সমস্ত বাধাকে পাড়ি দেয়া যায়। আমাদের শিশুদের এ সেতুতে পা দিতে নেই, যত্ন নিতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়, এ সেতুর কষ্ট বুঝতে হয়, সচেতনভাবেই।

শিক্ষার্থীদের পিঠ আক্রান্ত করে হাজার হাজার পদ্মা সেতুতে কোনো লাভ নেই।

লেখক: শিক্ষক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :