সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও বাস্তবতা...

অনুপম মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:১১

বাসায় ঢুকলেই প্রতিদিন আমার দুই কন্যা ঝাঁপিয়ে পরে আমার উপর, বলে ‘কী এনেছো?’। কিছু না কিছু তাদের জন্য নিয়ে তবেই বসায় যেতে হয়, এটাই রোজকার ঘটনা। চকলেট, পেস্ট্রি, আপেল, কমলা যাই হোক, তারা হাতে নিয়ে সমস্বরে চিৎকার করে বলে থ্যান্ন্যু (Thank you এখনো ভালো ভাবে বলতে পারে না)।

গত রাতে ঘটেছে বিশাল ঘটনা। কমলার প্যাকেট হাতে নিয়েই আমার বড় মেয়ে সায়রা নিবরাস বলে উঠলো ‘ধন্যবাদ’ সাথে প্রতিধ্বনি তুললো ছোট মেয়ে সায়রা নিহাদ। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে বললো। জানতে চাইলাম কে শিখিয়েছে, বললো পূজা মিস (প্লে গ্রুপে পড়ছে এখন)। পূজা মিস ও স্কুলের কর্তৃপক্ষকেও ধন্যবাদ...

কিছুদিন আগে একটা নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে বাংলাদেশের নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানে। সেখানে লিখিত পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন যিনি, তাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য বিবেচনা করা হয়নি সাক্ষাৎকার নেয়ার পর। কারণ প্রার্থী ভালো ইংরেজি বলতে পারছিলেন না। সেই প্রার্থীর সাথে দেখা হলে যেটা জানলাম, তার সারমর্ম হলো এই যে, তিনি খুব অভাবের তাড়নায় বড় হয়েছেন, ছোটবেলায় একটি মাদ্রাসায় পড়ার সুবাদে তাকে অনেকগুলো ভাষা রপ্ত করতে হয়েছে। যেমন, বাংলার পাশাপাশি আরবি (পুরোদমে, বরং সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই), উর্দু, ফার্সি এমনকি হিন্দিও বুঝতে হতো।

কারণ আরবি মাধ্যমে সবচেয়ে বড় মাদ্রাসাগুলো ভারতে অবস্থিত। সেই সুবাদে তিনি পারেনি ইংরেজির উপর বিশেষ জোর দিতে, বা হয়তো এতোটা সচেতন ছিলেন না। বাড়িতে এমন কেউ ছিলো না যে তাকে পরামর্শ দেবেন। যাইহোক, তার নিজের যোগ্যতা ও মেধার উপর ভর করেই সে বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নিয়োগ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেও নিয়োগ পেলেন না। শুধু তা ই নয়, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো, তিনি হয়তো পরীক্ষায় অসৎ উপায় অবলম্বন করেছেন।

এটা একটা বিশাল অপবাদ ছিলা তার বিরুদ্ধে। যাই হোক আমি তার সহপাঠীদের সঙ্গেও কথা বলেছি, প্রত্যেকেই তার সপক্ষে কথা বলেছেন, এমনকি এটাও বলেছেন, এই ছেলে বাংলাদেশের যে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রথম না হলেও সেরা দশের মধ্যেই থাকবেন। ভুল বলেনি, তিনি এখন খুব ভালো একটা সরকারি চাকরি করছেন।

আমাদের দেশে একমুখি শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বারবার আলোচনায় আসলেও তা বহুধাবিভক্ত। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা (কওমি ও আলিয়া দুই ধারায় বিভক্ত) আছে ইংরেজি ভার্সন এর বাংলা কারিকুলাম ও ইংরেজি মাধ্যম (ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড দুই ধারায় বিভক্ত)। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষা ও বিষয় থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এটা ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং সরকারের দুর্বল পর্যবেক্ষণের দরুণ বিদ্যালয়গুলোতে কেমন পাঠদান হচ্ছে, তা শিশুদের নিয়ে মায়েদের সন্ধ্যা পর্যন্ত কোচিং সেন্টারের ভিড় দেখলেই সহজে অনুমেয়। বাংলা নিয়ে নয় বরং ইংরেজি শিখাতেই অভিভাবকদের চিন্তা বেশি, কারণ প্রতিযোগিতায় যেন সন্তান পিছিয়ে না পরে।

উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভালো বাংলা বই পাওয়া যায় না, এটা অত্যন্ত পুরোনা অযুহাত। আর তাই বছরের পর বছর ধরে সিনিয়রদের নোট আর মূল বইয়ের ফটোকপিই ভরসা। অথচ উদ্যোগ নিলে সেই বইগুলো আমরা বাংলায় অনুবাদ করে ফেলতে পারতাম।

আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ভীষণ জরুরি। আইন জানা ও বোঝা প্রতিটি নাগরিক এর জন্য ভীষণ জরুরি। না জানলে আমরা আইন মানবো কীভাবে?

নিলাদ্রী (নীল ও আদ্রী মিলে এই নাম, অর্থাৎ নীল পর্বত), নীলোর্মি (নীল ঊর্মি অর্থাৎ নীল ঢেউ), রোদেলা (রৌদ্র দিনের আকাশ), মেঘলা (মেঘে ঢাকা আকাশ), পূর্ণিমা (পূর্ণিমার রাত) আঙ্গুর, বেদেনা (ফল বিশেষ), বৈশাখী, ফাল্গুনী (বাংলা মাসের নাম) এইসব বাংলায় অর্থপূর্ণ নামগুলো এখন শিশুদের জন্য ভাবা হয় না, বড্ড সেকেলে বলে! নামের আরবি (ধর্মীয় অনুভূতিই এখানে মুখ্য) ও ইংরেজির প্রাধান্য এখন লক্ষ্যণীয়।

এটা উল্লেখ্য যে, এখনো সনাতন ধর্মের অনুসারীদের নামে বাংলার শুদ্ধ চর্চা দেখা যায়। আমার নাম অনুপম মাহমুদ, অনুপম নামেই পরিচিত, তাই ক্যাম্পাস থেকে কর্মক্ষেত্র, সর্বত্রই আমাকে সবাই ‘দাদা’ নামে ডাকে। যদিও আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, তার পরেও এই দাদা নামটা ভীষণ উপভোগ করি।

ইতিমধ্যে বাংলা ভাষায় অনেক বিদেশি ভাষা ঢুকে গেছে। আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি এর সঙ্গে। একমাত্র সরকারি অফিস আদালতে ছাড়া আর কোথায় বাংলায় লেখার চল আছে কি না জানা নেই। করপোরেট কালচারের নামে ইংরেজির ভিড়ে বাংলা এখনকার আধুনিক ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণদের কাছে কেবল পরীক্ষায় বা ডিগ্রি অর্জনের জন্য একটি বিষয় মাত্র। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলা ব্যকরণ আমার কাছেও ছিলো ভীষণ ভয়ের, কারন আমি বুঝতে পারতাম না বা হয়তো বোঝানোর শিক্ষকের অভাব ছিলো, বা সেই সমইয়টায় আমি নিজেই সচেতন ছিলাম না। এতে আমার, আমার শিক্ষক এমনকি অভিভাবকদেরও দায় আছে।

কর্মক্ষেত্রে এমন অনেককেই জানি, যারা বাংলা লিখতে তো দূরের কথা, তারা পড়তে পর্যন্ত পারেন না, এ বড় দুঃখের। আমরা এমন এক জাতি, যারা এই বাংলা ভাষার জন্যই জীবন দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবো।

সিংগাপুরে ‘সিংলিশ’ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটা হচ্ছে সিঙ্গাপুরি স্থানীয় ভাষার সঙ্গে ইংরেজির সংমিশ্রণে সৃষ্ট নতুন এক ভাষা। সিংগাপুর ছোট্ট একটা দেশ, এখানে প্রচুর বিদেশির আসা যাওয়া। তারা সবাই বেশ ভালো ইংরেজি বলতে পারে, যেহেতু বিভিন্ন সেবা ও চাকরির সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের। তবে নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য তারা নিজেদের ভাষাই ব্যবহার করতো, কিন্ত নতুন এই সিংলিশ নিয়ে বর্তমানে সিংগাপুরের সরকার ও দেশের সুশীল সমাজ বেশ চিন্তিত। আমরাও কি তবে সেই বিপর্যয়ের খাদের কিনারায় না পৌঁছানোর আগে সচেতন হবো না?

আমাদের বাংলা ভাষার সাহিত্য মিয়ানমারের আরাকান রাজপ্রাসাদে পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আমাদের এই ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ অত্যন্ত সুপ্রাচীন। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় এই ভাষায় মানুষ কথা বলে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে গোটা বিশ্বে এই সংখ্যা নেয়ায়েতই কম নয়। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে সর্বপ্রথম একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাকে ঘৃণা করে ইংরেজি সাহিত্যে নাম করার চেষ্টা করেও ফিরে এসেছিলেন।

আমাদের নাটক চলচিত্র থেকে শুরু করে হালের জনপ্রিয় ব্যান্ড এর গান, সর্বত্র বাংলার করুণ উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। এছাড়া এফএম রেডিওতে সঞ্চালক (আর জে নামেই তারা পরিচিত) হিসেবে যারা আছেন, তারা অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলায় কথা বলেন। এটা নিয়ে আমার মনে হয় কম বেশী অনেকেই বিরক্ত। এটা ছাড়াও ইদানীং ভিনদেশীয় গানের জোয়ারে আমাদের বাংলা গানের ভেসে যাবার যোগাড় হয়েছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, মুরশেদী, গম্ভীরা, লালন, রাধা রমন, ঘেঁটু গান, শাহ আবদুল করিম, উকিল মুন্সি ছাড়াও অঞ্চল ভেদে আছে আরো নানা গুণী গীতিকার। তার পরেও বাংলা ভাষার প্রতি এই অবহেলা আমাদের গোটা সংস্কৃতির জন্য অশনি সংকেতই বটে। তাই বলে কি আমি বাংলার কথা কই বলে অতুল প্রসাদেরা আর গাইবে না?

কিন্তু যদি বাংলার কদর কমে যায়, যদি ইংরেজি বলতে না পারাটা হয় প্রধান অযোগ্যতা, তবে কাঠগড়ায় দাঁড়াবে কে? এই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলায় কথা বলা, বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে হৈচৈ আর বাংলা বর্ণমালা দিয়ে নানা ঢঙের পোশাকের দোকান সাজিয়ে ফ্যাশন হাউজ গুলো শুধু ব্যবসাই করবে? এক বৈশাখের প্রথম দিনে পান্তা খেয়ে বাঙালি হওয়া যায় না বা বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখা যাবে না, এটা বুঝতে আর কতদিন লাগবে আমাদের?

দেশে এখন অনুমোদন প্রাপ্ত ও পেতে যাচ্ছে এমন ইলেকট্রনিক গনমাধ্যমের সংখ্যা ৫০ হতে চললো। তার পরেও এই দেশের নয় বরং প্রতিবেশী দেশের চ্যানেল গুলোতে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, কেন? বিদেশি সিরিয়াল ডাবিং করে দিলেও আমরা গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছি কেন? এটা তদন্ত করে দেখলেই পাওয়া যাবে সর্বস্থরে বাংলা ভাষার অবস্থান এখন কোথায়?

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :