যৌবনহারা জবই বিল
দৃষ্টির সীমানাজুড়ে ফাঁকা মাঠ। কোথাও কোথাও নিচু জায়গায় জমে থাকা হাঁটুপানিতে মাছ শিকারের অপেক্ষায় দু-একটি সাদা বক আর পানকৌড়ির দল। মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রায় এক কিলোমিটার পিচঢালা পথ। তার দুই পাশে ইট-সিমেন্টের লাল-সাদা রং করা খুঁটি আপনাকে স্বাগত জানাবে পথজুড়ে।
কিছু পরেই দুই পারের সেতুবন্ধ দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ। রাতে সেখানে দাঁড়িয়ে চোখ দুটো আরেকটু সামনে মেলে ধরলে দেখা যাবে ভারত সীমান্তে জ্বলে থাকা সোডিয়াম বাতির হলুদ আলো।
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর সাপাহার উপজেলার জবই বিলের চিত্র এটি। নানা কারণে দিন দিন তার রূপ ও যৌবন হারাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বিলটি।
বিভিন্ন নথিপত্র অনুযায়ী, সাপাহার উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে বিলটির অবস্থান। ঐতিহ্যবাহী বিলটি উত্তরে ভারত থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণে পুনর্ভবা নদীতে মিলিত হওয়ায় যুগ যুগ ধরে সাপাহার উপজেলাবাসীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল। ১৯৯৯ সালে জবই বিলের ওপর ১.৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও ২০০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতুসহ ১৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করে উপজেলার এই বিভক্ত মোচন করা হয়।
সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, বিলটির প্রকৃত আয়তন প্রায় ১ হাজার একর, যা বর্ষা মৌসুমে ৫ হাজার একরে বিস্তৃত হয়। বিলের প্রকৃত নাম দামুর মাহিল বিল; কিন্তু এটি জবই গ্রামের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়ায় পরে এর নামকরণ হয় জবই বিল।
অতীতে বিলের বুক বেয়ে নৌকা যোগে লোকজন জবই গ্রামের ওপর দিয়ে সাপাহার উপজেলা সদরে আসা-যাওয়া করত। এই নৌপথের উত্তরের অংশকে বলা হতো দামুর বিল, দক্ষিণের অংশকে মাহিল।
বহু আগে খরা মৌসুমে পুরো উপজেলাসহ পাশের পত্নীতলা ও পোরশা উপজেলার কিছু অংশের মানুষ বিল বাহিচের সময় আসত এই বিলে মাছ ধরতে; সপ্তাহের দুটি দিন ধার্য ছিল মাছ ধরার জন্য- বিলের উত্তর অংশে মাছ ধরা হতো রোববার, আর দক্ষিণ অংশে মঙ্গলবার।
বিলে ধরা পড়ত ৩০-৪০ কেজি ওজনের বোয়াল, শোল, আইড়, গজারসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। প্রতিবছর এই বিলে মাছ ধরতে এসে একটি করে প্রাণ যেত বিলের মাছের আঘাতে। প্রতি বছর ঘটনাটি ঘটায় কুসংস্কার হিসেবে মানুষ ধরেই নিয়েছিল এটি মানুষ খেকো বিল।
প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা শাপলা, শালুকসহ অসংখ্য কাঁটাযুক্ত কচুরিপানায় পুরো বিল ঢেকে থাকত। সারা বিলে কোথাও একটুকু পানির দেখা মিলত না। শীতকালে বিলে বালিহাঁস, ছন্নিহাঁস, রাজহাসঁ, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, ডাহুকসহ প্রায় হাজার প্রজাতির এমনকি সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অসংখ্য অতিথি পাখি আসত এই বিলে। কিছু শৌখিন প্রকৃতির মানুষ বন্দুক নিয়ে বিলে আসত পাখি শিকার করতে।
এখন বিলটির কিছু সংস্কার হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। জাল যার জলা তার নীতি এখন আর নেই। ফলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউ মাছ ধরতে পারে না। সবাই মিলে একসাথে দিন ঠিক করে বিলে মাছ ধরার উৎসব হয় না। এখন মৎস্যজীবী সমিতির মাধ্যমে বিলে গড়ে তোলা প্রকল্পের মধ্যে মৎস্য চাষ হচ্ছে।
বর্তমানে এই বিলের উৎপাদিত মাছ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি রাজধানী ঢাকা শহরের কাওরান বাজারে বিক্রি হয়। কিন্তু আগের মতো ৩০-৪০ কেজি ওজনের মাছ আর ধরা পড়ে না। সুদূর সাইবেরিয়া দূরের কথা দেশীয় প্রজাতির পাখিও আর বিলে আসে না। এলাকার খামারিদের হাঁস বিলে বিচরণ করলে মাছ চাষের ক্ষতি হবে মনে করে মাছচাষিরা এখন হাঁসও আর বিলের পানিতে নামতে দেয় না।
ভারতের উজান ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পলিতে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে জবই বিল। খরা মৌসুমে বিল জুড়ে চাষ হচ্ছে ধান । তখন ওখানে গেলে মনেই হবে না এটি একটি বিল। চারদিকে শুধু ধানের মাঠ। যেদিকে চোখ যায় সবুজের সমারোহ।
বিলের এই দৈন্যের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, বিলটি খনন, নেটিং, বাঁধসহ সংস্কারের জন্য প্রায় ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন মিলেছে। অচিরেই সেখানে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।
(ঢাকাটাইমস/১৩ফেব্রুয়ারি/মোআ)