কর্মকর্তাদের যোগসাজসে উজাড় হচ্ছে চুনারুঘাটের অভয়ারণ্য

পাবেল খান চৌধুরী, হবিগঞ্জ থেকে
 | প্রকাশিত : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:৫৭

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে চলছে গাছ পাচারের মহোৎসব। আর এর সবই হচ্ছে বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজসে। রক্ষকরাই যেন অবতীর্ণ হয়েছেন ভক্ষকের ভূমিকায়। যার ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে গাছ পাচার ও লুটের ঘটনা। এর কাজে জড়িত আছে সরকারি দলের কতিপয় কিছু নেতার নেতৃত্বে তিন থেকে চারটি গ্রুপ। এসব গ্রুপের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে খোদ রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও।

প্রতিদিন রাতের আঁধারে ওই রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে গাছপাচারকারীরা রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে পাচার করছে। বন বিভাগরে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে গাছপালা পাচারের ফলে বনভূমি এখন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ও বনভূমি এলাকার নিকটবর্তী স্থানে বনভূমির অনুমোদন ছাড়া অসংখ্য করাত কল গড়ে উঠায় বনের গাছপালা দস্যুরা সহজেই করাত কলে মজুদ রাখতে পারছে। এরপর সুযোগ বুঝে রাতের আঁধারে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাক ও ট্রাক্টর যোগে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে।

সংরক্ষিত বনভূমি থেকে মূল্যবান বনসম্পদ অবৈধ পথে পাচারের ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে বনভূমিও হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষহীন। আর সরকার হারাচ্ছে প্রতি বছর শতকোটি টাকার রাজস্ব।

চুনারুঘাট উপজেলার কালেঙ্গা রেঞ্জের আওতায় রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ী ও রশিদপুর বিট। ওই চারটি বিটের বনভূমির বিশাল অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক ও সৃজিত বনায়ন রয়েছে। পাচার করা হচ্ছে সেগুন, মেহগুনি, আকামী, চাপালিশসহ মূল্যবান গাছ। পাহাড়ের গাছ কেটে গাছের গোড়া উপড়ে ফেলতে রয়েছে বনরক্ষীদের নিজস্ব লোকবল। বনরক্ষীদের প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে ‘মোথা থাকলে ব্যথা আছে’। এ কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিতে স্থানীয় বনরক্ষীরা বনের ভেতর গাছ কাটা হলে তা গোড়াসহ উপড়ে ফেলে।

এসব বনভূমি থেকে এক শ্রেণির অসাধু বনরক্ষীর পরোক্ষ মদদে বনভূমি থেকে মূল্যবান গাছপালা বনদস্যুরা কেটে উজার করে নিয়ে গেলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেন দেখেও না দেখার ভান করছে। অভিযোগ রয়েছে গাছ বিক্রির একটি বৃহৎ অংশ চলে যায় বনরক্ষী, কতিপয় পুলিশ, সরকারি দলের নামধারী কিছু নেতা ও সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির কিছু নেতা এবং কয়েকজন সাংবাদিকের পকেটে। বনজসম্পদ রক্ষার জন্য বনরক্ষীরা থাকলেও তারা বনদস্যুদের সাথে হাত মিলিয়ে গাছপালা পাচার করছে। ছনবাড়ী বনভূমিতে অনেক বছরের পুরনো সেগুনসহ বিভিন্ন মূল্যবান বৃক্ষরাজি দিনে দিনে হ্রাস পেয়ে বনভূমি বৃক্ষহীন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অর্থবছরে এসব বনভূমিতে প্রাকৃতিক ও সামাজিকভাবে বনায়ন করা হলেও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে বাগানগুলো ব্যর্থ হতে চলছে।

বন বিভাগের অর্থায়নে নতুন বাগান বনায়নের জন্য প্রতি বছর নার্সারি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি, ফলদ ও ভেষজ চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বনরক্ষীদের উদাসীনতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। বন বিভাগে সৃজিত বনায়নের আগাছা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ থাকলেও বনায়নের আগাছা দমনের কোনো পদক্ষেপ নেই। ওই টাকাগুলো চলে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষের পেটে।

রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ী ও বিভিন্ন বনবিটে বিভিন্ন সময়ে মূল্যবান আগড় গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপন করা হলেও আগাছা দমন না করায় জঙ্গলে ভরে গেছে। মাঝে মধ্যে বনবিভাগরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খুশি করতে বেছে বেছে কিছু এলাকায় ভালো বনায়ন করা হয়। কিন্তু বনের ভেতর বহু অঞ্চল রয়েছে যেখানে বনভূমি বৃক্ষহীন হয়ে পড়েছে বা নতুন বাগান বনায়নের কথা থাকলেও এগুলো রয়েছে মাত্র কাগুজে-কলমে।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকলেও প্রতিদিন বনের ভেতর দল বেঁধে শত শত মানুষ বনে প্রবেশ করে অবাধে বনের ছোট ছোট গাছপালা কেটে বনভূমি বিনষ্ট করছে। তাদের অত্যাচারে বনভূমি এখন ক্ষত-বিক্ষত। যারা অবাধে বনে প্রবেশ করছে তারা বনরক্ষীদের নির্দিষ্ট হারে টাকা দিয়ে বনে ঢুকে নির্ভয়ে বনজসম্পদ পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে।

কালেঙ্গা বনভূমিকে রক্ষার জন্য ইউএসএআইডির অর্থায়নে আইপ্যাকের সহযোগিতায় এলাকার বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হলেও এর কার্যক্রমও এখন ঝিমিয়ে পড়েছে।

সহ-ব্যবস্থাপনার সদস্যরা বনভূমি থেকে অবৈধ সুবিধা নিতে নিজেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ কারণে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও বনরক্ষীদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে।

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ও প্রকৃতি সংরক্ষণ পাহাড়ি বনভূমিতে জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার অভাবে বনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।

এ ব্যাপারে কালেঙ্গা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামান গাছ পাচার হওয়ার স্বীকার করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, গাছ পাচার হচ্ছে। তবে গাছ পাচার যেন না হয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নিজের বিরুদ্ধে পাচারে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে এই বন কর্মকর্তা বলেন, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত নই। আমার বাগানের কেউ এর সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজন জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, এগুলো আমি জানি না, তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। তবে এ ব্যাপারে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির কেউও মুখ খুলতে রাজি হননি।

(ঢাকাটাইমস/১৫ফেব্রুয়ারি/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :