না.গঞ্জে ডোবা-নালা পূর্ণ বিষাক্ত পানিতে, জীবন অতিষ্ঠ

আমির হুসাইন স্মিথ, নারায়ণগঞ্জ
 | প্রকাশিত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:২৩

তরল বর্জ্য নির্গমন করে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক-মিশ্রিত বর্জ্যে নারায়ণগঞ্জের খাল-বিল ডোবা-নালা ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। দূষিত হয়ে পড়ছে এলাকার পরিবেশ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তাদের। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

বুধবার বেলা একটা। পাগলার নন্দলালপুর এলাকার সফিক ডায়িংয়ে গিয়ে দেখা যায়, একটি সরু পাইপ দিয়ে কালচে রঙের পানি ড্রেনে পড়ছে। মিলের ভেতরে ইটিপি প্লান্ট চালু আছে। রাসায়নিক মিশ্রিত কুচকুচে কালো পানি একটি পাইপ দিয়ে গিয়ে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি পান্ট) পড়ে শোধন করা হচ্ছে। মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার নিরঞ্জর দেবনাথ জানান, ইটিপি প্লান্টটি বায়োলজিক্যাল প্লান্ট হওয়ায় পানির রঙ পরিবর্তন হচ্ছে না। এ ছাড়া শুক্রবার হওয়ায় মিলের বেশির ভাগ মেশিন বন্ধ। তাই মিলের যেসব রংয়ের ড্রাম আছে সেগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। ড্রামের পানি গিয়ে সরাসরি ড্রেনে পড়ছে। এ কারণে পানির রং কালচে দেখাচ্ছে।

পাগলা পিলকুনী ব্রিজ সংলগ্ন রুমা ডায়িং অ্যান্ড কালার কারখানা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচ বছরের বেশি সময় আগে। এই কারখানায় ইটিপি প্লান্ট নেই। কারখানায় প্রবেশ করতে চাইলে নিরাপত্তারক্ষী আবু বক্কর বাধা দিয়ে বলেন, দুপুরের সময় মিলের ম্যানেজারসহ কর্মকর্তারা ব্যস্ত আছেন।

ইটিপি প্লান্ট সম্পর্কে জানতে চাইরে আবু বক্কর জানান, তাদের ইটিপি প্লান্টের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মেশিন এনে তা চালু করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরে তাদের আবেদন জমা দেয়া আছে। আরো এক বছর সময় পাবেন ইটিপি প্লান্ট নির্মাণের জন্য।

বর্তমানে এই কারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি সরাসরি মিলের সামনের খালে ফেলা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই এভাবে চলছে।

নিরাপত্তারক্ষী আবু বক্কর দাবি করেন, ওই অঞ্চলের সব ডাই, রি-রোলিং মিল, সিলভার কারখানাসহ সব কারখানার রাসায়নিক-মিশ্রিত পানি খালে-বিলে ও ডোবা-নালায় ফেলা হচ্ছে।

পাগলা নন্দলালপুর এলাকায় অবস্থিত শুধু রুমা ডায়িং নয়, কাকলী ডায়িং. এম এস ডায়িং, পারভেজ ডায়িং, মমতাজ ডায়িং, সিটি ডায়িং, এম এম ডায়িংসহ সব কারখানার বর্জ্যমিশ্রিত বিষাক্ত পানি ফেলা হচ্ছে খাল, ডোবা-নালায়। এসব কারখানার বেশির ভাগের ইটিপি প্লান্ট নেই। আবার দু-একটি প্রতিষ্ঠানে তা থাকলেও খরচ বেশি বলে চালানো হয় না। রাসায়নিক বর্জ্যমিশ্রিত পানি ফেলা হচ্ছে কারখানার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডিএনডির পানি নিষ্কাশনের খাল বা ক্যানেলে। এই বিষাক্ত পানি ডিএনডির ক্যানেল দিয়ে এসে মিশছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। পাগলাসহ ঢাকার শ্যামপুর, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে তরল নির্গমনকাীর সব কারখানার পানি গিয়ে মিলছে এই শীতলক্ষ্যা নদীতে।

সিদ্ধিরগঞ্জ পাম্প হাউজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এম এ জব্বার জানান, ডিএনডির ভেতরে সেচখাল আছে ৫৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার, আর পানি নিষ্কাশন ক্যানেল রয়েছে ৪৫ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এই খাল ও ক্যানেলগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য মিশ্রিত পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। পানি এতটাই দূষিত ও বিষাক্ত যে, পাম্প হাউজের পানি নিষ্কাশনের সময় তাদের নাকে রুমাল চেপে কাজ করতে হয়। অনেক সময় বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে অফিস করাই দুরূহ হয়ে পড়ে।

পাগলা নন্দলালপুর এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোতালেব হোসেন জানান, পাগলা নন্দলালপুর এলাকার কাকলী ডায়িং, সফিক ডাইং, রুমা ডায়িং এম এস ডায়িং, পারভেজ ডায়িং, মমতাজ ডায়িং, সিটি ডায়িং, জি এম ডায়িংসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি তরল বর্জ্য নির্গমনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারণে এলাকার মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ ইটিপি প্লান্ট চালায় না। পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজাহিদুল ইসলাম জানান, রুমা ডাইং কারখানাকে পরিবেশ দূষণের দায়ে কয়েক দফা নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। দুবার এনফোর্সমেন্ট করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও তারা ইটিপি প্লান্ট নির্মাণ করেনি।

উপপরিচালক আরো জানান, সর্বশেষ পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ইটিপি প্লান্ট নির্মাণ ও চালু করা না হলে কারখানা সিলগালা করে দেয়া হবে।

কাকলী ডায়িংয়ের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানান, ইটিপি প্লান্ট নির্মাণ করলেও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। ছাড়পত্রের জন্য তারা আবেদন করেছে। সফিক ডায়িংয়ের ইটিপি প্লান্ট চালু আছে। এ ছাড়া এম এস ডায়িং, পারভেজ ডায়িং, মমতাজ ডায়িং, সিটি ডায়িং, জি এম ডায়িং, রুমা ডায়িংসহ ১২টি ডায়িং কারখানায় ইটিপি প্লান্ট নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে এনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে। তবে এর বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে একটি রিট করায় জরিমানা আদায় করা যায়নি। রিট নিষ্পত্তি হলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পাগলা নন্দলালপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব নজিবুর রহমান জানান, পাগলা নন্দলালপুর, পিলকুনি, নয়ামাটিসহ এ অঞ্চলের এমন কোনো জলাশয়, ডোবা-নালা নেই যেখানে শিল্পকাখানার বর্জ্য মিশ্রিত পানি নেই। ফলে খাল বিল, ডোবা নালা বিষাক্ত পানিতে সয়লাব। নাকে রুমাল চেপে চলাচল করতে হয় তাদের।

নারায়ণগঞ্জের পরিবেশবাদী সংগঠনের সমন্বয়ক এ টি এম কামাল জানান, শিল্পকারখানার বর্জ্য নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে আরো অনেক আগেই। বিশেষ করে ফতুল্লা, পাগলা, পিলকুনিসহ বেশ কয়েকটি এলাকার পরিবেশ দূষণ মাত্রাতিরিক্ত। এখানে মানুষের বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। মানুষ শ্বাসকষ্ট, চর্মসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝে মাঝে অভিযানের নামে জরিমানা করে। এটা আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই না। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপপরিচালক মো. মোজাহিদুল ইসলাম জানান, নারায়ণগঞ্জের ২৩৩টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি প্লান্ট আছে, ২৮টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি প্লান্ট নির্মাণাধীন, আর ৯০টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি প্লান্ট নেই। এসব কারখানাকে জরিমানা করা হয়েছে, ইটিপি নির্মাণের জন্য তাদের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইটিপি নির্মাণ করা না হলে কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৬ফেব্রুয়ারি/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :