বিবিএ পাস আর প্রশ্ন ফাঁস

প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:০৯

কাজী আনিস

আমার এক ছাত্র একদিন আলাপচারিতায় বলছিল, তার গ্রামের এক লোক ঢাকায় থাকতেন। অনেক আগে একবার তিনি গিয়েছিলেন গ্রামে। গ্রামের লোকজন লোকটাকে দেখার জন্য বাড়িতে ভিড় করল। ঢাকায় থাকেন তিনি! যেনতেন নয়; এ এক বিরাট বিষয়। বড় লোক। ঢাকার ওই বাসিন্দাকে দেখে ওইদিন কেউ কেউ হয়তো, ‌'ইস, আমি যদি তাঁর মতো ঢাকায় থাকতে পারতাম' বলেছিল। বৃদ্ধরা আফসোস করেছিল, ‌'জীবনডা শ্যাষ হইয়া গেল। ঢাকায় থাকতে পারলাম না।' ছোটরা মনে হয় পরীক্ষায় জীবনের লক্ষ্য লিখতে গিয়ে ‌'বড় হয়ে ঢাকায় থাকাই আমার জীবনের লক্ষ্য' লিখেছিল।

দিন বদলেছে, সময় গড়িয়েছে। গ্রামেগঞ্জে পূর্বের বিরাজমান ঢাকার ‌'কারিশমা' আর ‌'প্রেস্টিজ' নেই। বরং তলানিতে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বাড়িতে গেলে আমি ‌'তলানি' টের পাই। মা যখন প্লেটে শাক-সবজি, মাছ তুলে দিতে যায়, তখন 'না, না' করি। মা বলে, 'হাছু না। ঢাহাত এল্লে টাটকা জিনিস পছ নে?' মানে, ‌'খা। ঢাকায় কি এমন টাটকা জিনিস পাস?'।

গ্রামেগঞ্জে ঢাকার ইমেজ এখন বাসী খাবার, ফরমালিনযুক্ত ফল, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা, তীব্র যানজট, ধুলোবালি, বিকট হর্ন ইত্যাদি। ভাগ্যক্রমে ফরমালিনমুক্ত ফল পাওয়া মানেই গণমাধ্যমের নিউজ হওয়া, ‌'ফরমালিনমুক্ত আম বিক্রি করছে ফজর আলী।' যদি আজ কোনো এক অদৃশ্যের ছোঁয়ায় রাস্তাঘাট পরিষ্কার হয়ে যায়, যানজট কমে যায়, ধুলোবালি আর হর্নমুক্ত শহর গড়ে উঠে-তাহলে এটা হবে লীড নিউজ। এ পরিবর্তন হবে ঢাকার জন্য নতুন। নতুন মানেই নিউজ। উন্নয়ন হলে তো আরও বেশি। উন্নয়নমূলক সাংবাদিকতা।

একটি জাতীয় পত্রিকায় এক ছাত্রীর বিবিএ পাস করার নিউজ দেখে এসব কথা বললাম। অনেকেই সংবাদ মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই স্যাটায়ার করেছেন। আমি ভাবছি উল্টো। হাল আমলে প্রশ্নফাঁসের যে রমরমা অভিযোগ দেখছি আর অনেককেই ফেসবুকে তার প্রমাণ দিতে দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এ ‌'পাস করা'র সংবাদ হবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। উন্নয়নমূলক সাংবাদিকতা তো বটেই।

কীভাবে? আমি নিশ্চিত ওই ছাত্রী আগে থেকেই কোনো প্রশ্ন না পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। লেখাপড়া করেছে। আমাদের সমাজের জন্য এ ছাত্রী হতে পারে আদর্শ, রোল মডেল। অদূর ভবিষ্যতে আমার ছেলে ফারশিদ যদি আগেভাগে প্রশ্ন না পেয়ে পরীক্ষা দেয়, তাহলে দেখবেন আমার বাসার সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। সাংবাদিকেরা গিয়ে রিপোর্ট করবে। সেকেন্ড লিড নিউজ, ‌'প্রশ্ন না পেয়েই পরীক্ষা দিল ফারশিদ', ‌'অনন্য ফারশিদ'। আর পাস করলে তো কথাই নেই। লিড নিউজ। ড. ইউনুস যেদিন নোবেল পেয়েছিল, সেই নিউজের শিরোনামের মতো, ‌'তোরা সব জয়ধ্বনি কর।' অথবা টাইগারদের জয়ের নিউজের মতো, 'ফারশিদের গর্জন শুনেছে বিশ্ব।'

আসলেই ফান নয়। আমি আতঙ্কিত। আবার আশ্চর্য লাগে, প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যাথা নেই। হাল আমলে সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন দাবি দেখছি। সংসদ সরব দেখছি। ক্ষতিপূরণের দাবি দেখছি। কিন্তু দিনের পর দিন আমাদের সন্তানদের যে ক্ষতি করা হচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ দেবে কে? সংসদে এ নিয়ে সরব হবে কে?

দেখছি, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন। বাংলার প্রতিটা ঘরের সন্তান সুন্দর, সুন্দর মানুষ। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে আমাদের এ সুন্দর মানুষগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে কে?

বিবিএ পাসের নিউজে সবাই দেখছে ‌'নিউজ ভ্যালু' না থাকা, আমি দেখছি 'সমাজ ভ্যালু' না থাকা। প্রশ্ন ফাঁসের এ জমানায় কেন জানি মনে হচ্ছে এ নিউজ এক ভয়ংকর অশনি সংকেত।

লেখক: শিক্ষক,স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।