নিরাপত্তা সম্মেলনে বাংলাদেশ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২৩:০১ | প্রকাশিত : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:৫৯

নব্বইয়ের দশকে, বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সাথী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে গেলে একক ‘বিশ্বমোড়ল’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সময়ের পরিবর্তনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত ধরে বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার পুনরুত্থানের ফলে মার্কিন মোড়লিপনা অনেকটাই কমে এসেছে। সিরিয়া, চীন, ইরান এবং উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইচ্ছেমত’ কাজ করতে না পারাই বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মার্কিন প্রভাব কমে আসার বড় উদাহরণ। এমনি পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জার্মানির মিউনিখে শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী নিরাপত্তা সম্মেলন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে দেশের সশস্র বাহিনীগুলোকে ‘যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রতিবেশী এস্তনিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত সামরিক বাহিনীগুলো তাদের সদস্যদের প্রেরণ করলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট এ নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব, সাম্প্রতিককালে ইউক্রেন ভেঙে ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সাথে অন্তর্ভুক্তি, সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার সরাসরি সামরিক অংশগ্রহণ এবং সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভ্লাদিমির পুতিনের কথিত প্রভাব খাটানো, তুরস্ক ও রাশিয়ার কাছে আসা এবং তুরস্কে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের খুন হওয়া ইত্যাদি কারণে মিউনিখের এই নিরাপত্তা সম্মেলন নতুন মাত্রা লাভ করেছে।

তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, সিরিয়া, আফ্রিকার লিবিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট অভিবাসী সংকট; স্থিতিশীল জীবনের খোঁজে অভিবাসীদের যেনতেনভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জার্মানি, ইতালি, গ্রিস, পোল্যান্ড এ প্রবেশের চেষ্টা; অভিবাসীদের রাখা হবে কি না প্রশ্নে সরকার ও জনগণের দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান এবং জার্মানি, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে একাধিক সন্ত্রাসী হামলা ইত্যাদি কারণে ৫৩তম নিরাপত্তা সম্মেলন বিশ্ববাসীর জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ইভেন্ট হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

বিশ্বের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, বিভিন্ন সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জোট, উন্নয়নশীল এবং উন্নত উভয় প্রকৃতির দেশের সরকারগুলোর কাছে নিরাপত্তা সম্মেলন অত্যন্ত কার্যকর একটি প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত। একটা তুলনামূলক শান্তির বিশ্ব গড়তে বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে নিরাপত্তা সম্মেলনকেই বেছে নেন বিশ্বনেতা ও নীতি নির্ধারকরা। নিরাপত্তা সম্মেলনের গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সটি অব পেনসেলভিনিয়া একে টানা চতুর্থবারের মতো ‘Best Think Tank Conference" in the world’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই নিরাপত্তা সম্মেলনে নিজেদের প্রতিনিধিদের প্রেরণ না করার ভুল করে না। বাংলাদেশ থেকে এবার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্ভবত এবারই প্রথম শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিলেন। সম্মেলনের মূল পর্ব শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে আরম্ভ হয়। শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক নানা নিরাপত্তা ইস্যু ও বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলের সাথে শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কর্মসূচিও রয়েছে।

শেখ হাসিনার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনেতা নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। ১৬টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, ১৫টি দেশের সরকার প্রধান, ৪৭ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩০ জন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তনিও গুতেরেসসহ ৫৯টি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং বিশ্বের ৬৫ জন শীর্ষ ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন।

শত্রু-মিত্র এমন কেউ নেই যে এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। বহুল আলোচিত নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস মেটিস এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। রাশিয়া থেকে অংশ নিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারগেই লেভরভ।

ইউরোপীয় কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক, ইইউ শীর্ষ প্রতিনিধি ফেডেরিকা মোঘেরিনি, ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টোলেনবার্গ, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পেট্রো পোরোশেংকো, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ ঘানি, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলবার্গ, হাংগেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবিন, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবেদ আল-জুবায়ের, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ শরিফ, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডর লিবেরমেন, রেডক্রস ইন্টারন্যাশনাল কমিটির প্রেসিডেন্ট পিটার মওরের, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রোথ অন্যান্যদের মধ্যে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ‘আইএস’ নাম ব্যবহার করে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন এবং সরকারের কাজে নাক গলানোর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘এক দুই ফোঁটা মেঘ হলেই তাকে বৃষ্টি বলা যায় না’।

পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যাচার এবং সরকারের শক্ত হাতে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং চূড়ান্তভাবে কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংকের মিথ্যাচার প্রমাণিত হওয়া, চীন থেকে সাবমেরিন ক্রয়, চীনের প্রেসিডেন্ট এর ঢাকা সফর এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, সাবমেরিন ক্রয় পরবর্তী সময়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকায় ঝটিকা সফর ইত্যাদি নানা ঘটনায় বাংলাদেশের বিশ্ব আঙিনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠাকে প্রতিভাত করে। এমনি পরিস্থিতিতে জার্মানিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গমন বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :