মাতৃভাষা দিবসের ভাবনা

মো. মশিয়ার রহমান
 | প্রকাশিত : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৮:৫৯

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত সাদৃশ্য না থাকলেও শুধু ধর্মের কারণে পাকিস্তানে পড়ে যায় তখনকার পূর্ব বাংলা। তবে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর মুখোশ খুলতে দেরি হয় না। তারা সর্বপ্রথম আক্রমণ করে আমাদের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার উপর। অথচ

পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত। তারপরও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়।

একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা হবে সে ভাষা; যে ভাষায় অধিকাংশ জনগোষ্ঠী কথা বলে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের উপর সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই। যার ফলে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় এবং ঝরে যায় বহু তাজা প্রাণ। শহিদ হন আবুল বরকত, জব্বার, রফিক, ছালামসহ আরো অনেকে, অনেকে আহত হন। ২২শে ফেব্রুয়ারি শহিদ হন শফিউর রহমান। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি আর বাংলা ভাষাকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্ববাসীর কাছে।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সুসংহত স্ফুরণ; বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ছিল মুখ্যত একটি জাতীয় সংগ্রাম। আর এর মূল কথা ছিল ভাষাগত স্বতন্ত্রচেতনা।

একুশ ফেব্রুয়ারি কেবল ওই একটি দিন কিংবা তারিখকেন্দ্রিক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; একটি জাতির, একটি ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদার ওপর আসতে-থাকা আঘাতের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ধারাবাহিক-পরিকল্পিত চেতনার যোগফল।

হাজার বছরের বাংলার ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর বাংলা ভাষাসম্পদের চারিত্র্য রক্ষার অবশ্যম্ভাবী প্রতিবাদের অপর নাম একুশে ফেব্রুয়ারি।

ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতালাভের পর থেকে বায়ান্ন-পরবর্তী সময়েও চলতে থাকে এই চেতনার বাদ-প্রতিবাদ। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ এবং পাকিস্তানের স্বাধীনাতাপ্রাপ্তির (১৪ আগস্ট ১৯৪৭) অব্যবহিত পরেই পূর্ব-পাকিস্তানের (আজকের ‘বাংলাদেশ’ নামক ভূখন্ড) জনগণ উপলব্ধি করেছে তাদের ঘোরলাগা-মেকি রঙমাখা চোখে আঁকা ‘সোনালি স্বপ্নে’র বাস্তবতা।

তারা তখন দেখতে শুরু করেছে সামন্ত বাদ-সাম্রাজ্যবাদের নিষ্পেষণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শিক্ষা-ভাষা-সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিচরণে প্রতিবন্ধকতা আর গণতন্ত্র নির্বাসনের ইঙ্গিত।

১৯৪৮ সালে প্রাদেশিক পরিষদে ব্যাপকভাবে আলোচিত হবার পর বাংলা ভাষার বিরোধিরা আন্তরিকভাবে না হলেও বাংলা ভাষার রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যুক্তি স্বীকার করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাদের মনের কথা ছিল অন্যরকম। আধিপত্যবাদী-আগ্রাসি শাসক ইংরেজ যেমন ভারতের জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে নিজ ভাষাকে এ ভূখন্ডে দিয়েছিল বিশেষ মর্যাদা, নবগঠিত পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠীও পূর্ব পাকিস্তানের জনতার ভাষাকে অবহেলা করে, রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে, চাপিয়ে দিতে চাইল তাদের ভাষা উর্দুকে।

তখন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং অন্যঅর্থে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংঘটিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলন বা ভাষা-সংগ্রাম। সংখ্যাগুরু হওয়া সত্বেও পাকিস্তানের আইন- পরিষদে এবং অন্যত্র বাঙালির প্রভাব হবে উর্দুভাষীয় চেয়ে কম এমনটি সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি সেদিনের বাংলাভাষী মানুষ।

এই সংগ্রামের ইতিহাস ও প্রসঙ্গ কেবল আলংকারি বর্ণনা-ভাষ্য নয়; এর ভেতরে রয়েছে আবেগ আর জাতীয়তা-সংলগ্নতার উর্বর বীজতলা। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ কিংবা ‘মাগো ওরা বলে,/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না’- এইসব উত্তেজক-জনপ্রিয় গান-কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে জন্মসূত্রে পাওয়া মায়ের ভাষা ব্যবহার করার অধিকারবোধ।

১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি, বাঙালি, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে, প্রাদেশিক বাজেট অধিবেশন চলাকালে, সরকারঘোষিত আন্দোলন-প্রতিরোধক ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে, দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে এবং জীবন উৎসর্গ করে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাজপথে রক্তদান মানব ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। জাতিসত্তার ধারণা বদলে দিতে পারে এমন ঘটনা সব সময়ে ঘটে না। কিন্তু ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তেমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। আবহমান বাংলার ইতিহাসে ধূমকেতুর আবির্ভাবের মতো এই ঘটনা বাঙালি জাতিসত্তার ধারণায় নতুন মাত্র যোগ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চিত করে রাখে এক অমিত সম্ভাবনা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সে সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল বহিপ্রকাশ।

মায়ের প্রতি ভালোবাসার মতোই আমাদের আবেগকে উদ্বেলিত করে, সংগ্রামে প্রেরণা দেয়, সংকটে দেয় আশ্রয় দেয় মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষা। ১৯৫৩ সাল হতে ভাষা-আন্দোলনের এই দিনটি ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয় এবং ১৯৫৬-তে বাংলা ভাষা, উর্দুর পাশাপাশি, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে।

কানাডা প্রবাসী কয়েকজন বাঙালির উদ্যোগও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারের কুটনৈতিক তৎপরতার ফলে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার এই দুর্লভ আত্মত্যাগ ও চরম মূল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারির শহিদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৯৭ সালে ১ জানুয়ারি ‘বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপ’ নামে যে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করেছিল, সেটিই পরবর্তীকালে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নাম ধারণ করে। এই নব-নামাঙ্কিত সংগঠনটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার যাবতীয় সাংগঠনিক- প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন করে।

এতোদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ব্যাপকভাবে কেবল বাংলাদেশে পালিত হতো; আর বাংলাদেশের বাইরে আংশিকভাবে পালিত হতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও ত্রিপুরায়। ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘভুক্ত দেশসমূহে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে । এতে করে সারাবিশ্বে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম, আলোচনার টেবিলে জায়গা পেয়েছে ভাষা-শহিদদের আত্মত্যাগের মহিমা এবং বাঙালির শৌর্য ও বীরত্বের কথামালা।

একুশ থেকে আমরা লাভ করেছি ঐতিহ্য পুনর্গঠনের বিষয়-পরিসর। শহিদ মিনারের গঠন, প্রভাতফেরি অনুষ্ঠান বা আলপনার ব্যবহারের মধ্যে তার প্রতিফলন রয়েছে- বিশেষভাবে প্রাচীন কৃষিসংস্কৃতির অন্যতম লোকশিল্প আলপনার যে নবরূপায়ন এখানে ঘটেছে, তা এক অভিনব আধুনিক সংযোজন।

শহিদ মিনারের ভাস্কর্যের মধ্যে ইউরোপীয় কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় চেতনার মিশ্রণ। প্রভাত ফেরির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অজ্ঞাত অতীতের খালি পায়ে পরিভ্রমণের স্মৃতি। মূলত একুশের অনুষঙ্গ যে আবহ সৃষ্টি করে, তা নতুনভাবে গড়ে ওঠা এক সমৃদ্ধ আধুনিক জাতিসত্তার গাঠনিক উপাদান, চেতনায় যা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়বাহী।

ভাষা-আন্দোলন সংঘটিত হবার প্রায় ছয় দশক অতিক্রান্ত হলেও, আজও তৈরি হয়নি এর নির্ভরযোগ্য ইতিহাস। সংগ্রামে পুরোভাগে নেতৃত্বে কারা ছিলেন, কতজন প্রাণ দিয়েছেন, কতজন আহত হয়েছেন এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কী? এসবের সঠিক হিসাব পাওয়া অন্তত কঠিন নয়। কারণ আজও জীবিত ও সক্রিয় রয়েছেন বেশকজন ভাষাসৈনিক। রয়েছে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচেষ্টা; রয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, অন্যান্য গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী ২১ তারিখে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৩ (তিন) জন, আহত ৩০০ (তিনশত ) জন ও গ্রেফতার ১৮০ (একশত আশি) জন; ২৩ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে পরিবেশিত তথ্য থেকে জানা যায়, নিহত ৫ (পাঁচ) জন, আহত ১২৫ (একশত পঁচিশ) জন ও গ্রেফতার ৩০ (ত্রিশ) জন; ২৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সভা থেকে সরকারকে ৭৫ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে যে পত্র দেয়া হয়, তাতে ৩৯ (উনচল্লিশ) জন শহিদ হয়েছেন বলে দাবি করা হয় (এবং ওই সভায় ৫ মার্চ ‘শহিদ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়)।

২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭ (সাত) টায় লেখা একুশের প্রথম কবিতায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী বলেছেন- ‘ওরা চল্লিশ জন কিংবা আরো বেশী/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ/কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে’; প্রভাত ফেরিতে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর যে গান আমরা গাই , তাতে তিনি লিখেছেন- ‘ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।

আজকের প্রজন্মের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের মাহাত্ম্যকে তুলে ধরতে হলে প্রয়োজন ইতিহাস-অন্বেষা এবং সঠিক তথ্য পরিবেশের সদিচ্ছা। রাষ্ট্র, সরকারি-বেসরকারি প্রচারমাধ্যম কিংবা বাংলা একাডেমিসহ অন্যান্য গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় এ দায়িত্ব পালনের দায় গ্রহণ করতে পারে।

ভাষাকে বাঁচাতে হলে, ভাষার মর্যাদা ও অধিকারকে সমুন্নত রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন ভাষা পরিকল্পনা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আমাদের অগ্রজপ্রতিমরা ভাষার জন্য যে আত্মাহুতি দিয়েছিল; সে উদ্দেশ্য আজও বাস্তবায়িত হয় নাই।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার আজও নিশ্চিত করতে পারি নাই। সব সরকারই এ ব্যাপারে নিরব ভূমিকা পালন করেছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আসলে অতিরিক্ত ভাষাপ্রীতি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়।

এছাড়াও ভুল বানানে লেখা ও ভুল উচ্চারণ ভাষার অস্তিত্ব সংকটের কথা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। আমাদের দেশেও বাংলাভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা রয়েছে। আমরা এসব নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে সচেষ্ট হব। সর্বস্তরে বাংলাভাষার ব্যবহার, ভাষার ঐতিহ্য রক্ষা হলেই শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে বৈকি!

মো. মশিয়ার রহমান : শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/২০ফেব্রুয়ারি/এমআর/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :