অপূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার!

তায়েব মিল্লাত হোসেন
| আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৯:৫৭ | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:৩০

ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে শিল্পী হামিদুর রাহমান একটি শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শিল্পীর পরিকল্পনার একটিমাত্র অংশ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইপত্র ঘেঁটে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

এমনকি শহীদ মিনারের বেদীগুলো পর্যন্ত শিল্পীর ভাবনায় থাকা নির্মাণ উপকরণের ছোঁয়া পায়নি। তাই ১৯৮৬ সালে দেশে এসে বর্তমান শহীদ মিনার দেখে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন হামিদুর রাহমান।

এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালে প্রকাশিত তার ছোট ভাই প্রয়াত নাট্যকার ও লেখক সাঈদ আহমদের এক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করা হয়েছে-

“শহীদ মিনারের কাছে গিয়ে যৌবনের শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘মিনারের স্ট্রেইন গ্লাস এখনও লাগানো হয়নি; ওটা আমার পরিকল্পনায় ছিলো।’ ওই বছর যখন ঢাকায় তার চিত্রপ্রদর্শনী হচ্ছিল তখন মেজর জেনারেল সিদ্দিকী পূর্তমন্ত্রী। তার সঙ্গে হামিদুর রহমানের সাক্ষাৎ হয়। শহীদ মিনারের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্পর্কে তাদের মধ্যে কথাবার্তাও হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কোন কাজ শুরু করতে এত সময় লেগে যায় যে, কোন সৃজনশীল শিল্পীর ধৈর্য্য ও আয়ু এর অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। হামিদুর রহমানও তার স্বপ্নের শহীদ মিনারের পূর্ণ বাস্তবায়ন করে যেতে পারলেন না।”

শহীদ মিনার কমপ্লেক্স পুরো রূপ না পাওয়ায় একাধিক ভাষা সৈনিক তাদের লেখা ও স্মৃতিচারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, পাকিস্তান আমলে সামরিক সরকারগুলোর প্রতিহিংসার কারণে শিল্পী হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আর রহস্যজনক কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারগুলোও পাকিস্তান আমলের সরকারগুলোর সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে।

শিল্পী হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনামাফিক শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মানে বর্তমান সরকারকে উদ্যোগ দেখতে চান ভাষা সৈনিকরা। এ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আদালতের আশ্রয় পর্যন্ত নিয়েছেন। আদালতও চায় সরকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণ করুক। এতে করে হামিদুর রাহমানের নকশার আদলে শহীদ মিনার কমপ্লেক্স অনেকটাই পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।

যা ছিল প্রথম নকশায়

স্থাপত্য অধিদপ্তরে সংরক্ষিত একটি নথি ও ১৯৫৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রণীত শহীদ মিনারের একটি ‘প্ল্যান’ থেকে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে সরকারি উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মান কমিটি গঠন করা হয়। এজন্যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় এক লাখ টাকা। শহীদ মিনার নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানে ছিল তৎকালীন সিএন্ডবি (কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিল্ডিং) বিভাগ। শহীদ মিনার পরিকল্পনা করেছিলেন শিল্পী হামিদুর রাহমান। তার সহযোগী ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। আর মিনার নকশাবিদ ছিলেন তৎকালীন প্রধান সরকারি স্থপতি জিন ডেল্যুরেন।

তবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের একাধিক বইয়ে শহীদ মিনারের নকশাবিদ হিসেবে স্থপতি জিন ডেল্যুরেনের নাম পাওয়া যায়নি। রফিকুল ইসলামের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৫৭ সালে শহীদ মিনারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী এ জব্বারের উপর। এ জব্বার ও শিল্পী জয়নুল আবেদীনের অনুরোধে শিল্পী হামিদুর রাহমান শহীদ মিনারের একটি মডেল এবং ৫২টি নকশা-পরিকল্পনা তাদের কাছে জমা দেন। অন্যান্য স্থপতি ও শিল্পীরাও প্রতিযোগিতামূলক নকশা দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রীক স্থপতি ডক্সিয়াডেস, প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীনের স্বমন্বয়ে গঠিত কমিটি হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনা নির্বাচন করে।

শহীদ মিনার নিয়ে কি পরিকল্পনা ছিল হামিদুর রাহমানের- এ প্রসঙ্গে বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ আছে, শিল্পী হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনায় ছিল অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমপ্লেক্স। নকশায় মিনারের মূল অংশে ছিল মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো মা ও তাঁর শহীদ সন্তানের প্রতীক হিসেবে অর্ধবৃত্তাকার স্তম্ভের পরিকল্পনা। স্তম্ভের গায়ে হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের অসংখ্য চোখের প্রতীক খোদাই করে বসানোর কথা ছিল। যেগুলি থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো মিনার-চত্বরে বর্ণালির ‘ইফেক্ট’ তৈরি করবে।

এছাড়া মিনার-স্থাপত্যের সামনে বাংলা বর্ণমালায় গাঁথা একটি পূর্ণাঙ্গ রেলিং তৈরি করার পরিকল্পনা ছিলো। মিনার চত্বরে প্রতীকিভাবে শহীদদের রক্তমাখা পায়ের ছাপ ও দানবের কালো রঙের পায়ের ছাপ আঁকার বিষয়টিও মূল পরিকল্পনায় ছিল।

এরপাশে তৈরি হওয়ার কথা ছিল জাদুঘর, পাঠাগার ও সংগ্রাম-বিষয়ক দীর্ঘ দেয়ালচিত্র (ম্যুরাল)। আশপাশের জায়গা নিয়ে চোখের আকৃতিবিশিষ্ট ঝরণা নির্মাণের পরিকল্পনাও ছিল, যার প্রান্তে থাকবে ঢেউ-খেলানো উঁচু বেদি।

দিনে দিনে সংকুচিত এক মিনার

পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে তিনবার শহীদ মিনার নির্মিত হলেও কোনো শহীদ মিনারেই হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রতিটি শহীদ মিনারেই ক্রমশ সংকুচিত হয়ে এসেছে শহীদ মিনারের নকশা।

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, তখনকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনের যেখানে ভাষা শহীদ আবুল বরকত পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সেই জায়গায় শহীদ মিনার নির্মানের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৫৬ সালে এই জায়গা নির্বাচন করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের পূর্ত মন্ত্রী আবদুস সালাম খান।

ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্র-জনতা ভাষা শহীদ আওয়ালের ছয় বছর বয়সী কন্যা বসিরণকে দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করায়। পরদিন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন।

আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের সময় ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনারের নির্মানকাজ শুরু হয়। হামিদুর রাহমানের মূল পরিকল্পনাটি ছিল বেশ বড়সড়। তা বাস্তবায়নে দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্যে উদ্যোগী হন শিল্পী।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালে দৈনিক পাকিস্তান-এ প্রকাশিত শিল্পী হামিদুর রাহমানের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, শিল্পীর ইচ্ছে ছিলো শহীদ মিনারের কাজ করতে ২৪ ঘন্টাই যেন ওখানে অবস্থান করতে পারেন। এজন্যে নির্মাণকাজের পাশে দুটো বেড়ার ঘর তৈরি করা হয়েছিল। শিল্পী একটিতে থাকতেন, আরেকটিতে কাজ করতেন।

এরফলে ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের ভিত, মঞ্চ ও তিনটি স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এরমধ্যে ভাষা আন্দোলনের ওপর হাজার বর্গফুটের একটি ম্যুরালের দুই স্তরের কাজ শিল্পী হামিদুর রাহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদ শহীদ মিনারের নিচের ঘরে শেষ করেন।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সামরিক আইন জারি হলে হামিদুর রাহমানের উদ্যোগ থেমে যায়। সরকার শহীদ মিনার তৈরির কাজ বন্ধ করে দেয়, বেজমেন্টের ম্যুরালের ক্ষতিসাধন করে। চারদিকে তখন সামরিক সরকারের দমন-পীড়ন, ধরপাকড় চলছে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি চলে যান শিল্পী হামিদুর রাহমান।

সেই সময়ে করাচীতে অবস্থানরত নাট্যকার সাঈদ আহমদের স্মৃতিচারণ, “...বলেন, ‘আমি খুব অল্প লোককে জানিয়ে তোমার এখানে এসেছি। কালকে নিউইয়র্ক চলে যাব। যে দেশে শিল্পকর্ম ধিকৃত সে দেশ যত শিগগির সম্ভব ছেড়ে দেয়াই ভাল। সরকার আমার শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এবং ম্যুরালে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে।’ এই বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি। এর আগে হামিদুর রাহমানকে এভাবে কাঁদতে দেখিনি কোনদিন।”

প্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কথা

চার বছর অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল নির্মানাধীন শহীদ মিনার। ওইসময়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষ এই অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারেই ফুল দিয়েছে, সভা করেছে ও শপথ নিয়েছে বলে জানা যায় বাংলাপিডিয়া থেকে।

১৯৬২ সালে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন পূর্ববঙ্গের তখনকার গভর্নর লে. জে. আজম খান। ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবিরা থাকলেও তাদের সুপারিশেই শহীদ মিনার নির্মাণে হামিদুর রাহমানের প্রথম পরিকল্পনাটি সংকুচিত হয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।

স্থাপত্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে নির্মিত শহীদ মিনারে পাঁচটি স্তম্ভ ছিল। চতুষ্কোণ স্তম্ভগুলো কংক্রিটের তৈরি ছিল। মাঝের স্তম্ভটি আকার-আকৃতিকে বড় ছিল; উচ্চতায় ৩৩ ফুট। স্তম্ভগুলোর বেজমেন্টে একটি বড় হলঘরের মত ছিল। এর দেয়ালে ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছিল। যাতে প্রতীকিভাবে ভাষা আন্দোলনকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ পর্ব...

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারা বেজমেন্টের ম্যুরালও ধ্বংস করে।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ মিনার নতুন করে তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারও মূল নকশা পরিহার করে ১৯৬৩ সালের সংক্ষিপ্ত নকশার আদলেই দ্রুত কাজ শেষ করা হয়।

একজন ভাষা সৈনিকের মতে, সরকার তাড়াহুড়ো করে ১৯৭৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই শহীদ মিনারের কাজ জোড়াতালি দিয়ে শেষ করে। অথচ ১৯৬২-১৯৬৩ সালে শহীদ মিনার নির্মাণের সরকারি উদ্যোগে ছিল হঠকারিতা।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘তীব্র ছাত্র অসন্তোষ ও বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্যেই জেনারেল আজম খান শহীদ মিনার সমাপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সমাপ্ত শহীদ মিনার শিল্পী হামিদুর রাহমানের মূল নকশাভিত্তিক হলেও শহীদ মিনারের স্তম্ভে যে চোখের নকশা থাকার কথা ছিল তার পরিবর্তে সেখানে লোহার শিক গলিয়ে দেয়া হয়। সূর্যের প্রতিফলন, ঝর্ণা, ঘড়ি, ভাস্কর্য, ম্যুরাল সব বাদ পড়ে। সৃষ্টি হয় কারাগারের লৌহ কবাটের আদল।’

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৭৬ সালে নতুন করে শহীদ মিনার নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) হামিদুর রাহমানের নকশার আলোকেই তিনটি সম্ভাব্য নকশা তৈরি করে একটি প্রস্তাবনা দেয় সরকারকে। আশেপাশের সবচেয়ে কম জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে, এমন সম্ভাব্য নকশা অনুসারে স্থাপত্য অধিদপ্তর একটি ‘প্ল্যান’ তৈরি করে। এতে শহীদ মিনারের মাঝের স্তম্ভটির উচ্চতা বাড়িয়ে ৫৪ ফুট করা হয়।

নির্মাণকাজের বাজেট ধরা হয় ৪৭ লক্ষ টাকা। কিন্তু এই উদ্যোগটি কয়েক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। পরে ১৯৮৩ সালে শহীদ মিনার নির্মান প্রক্রিয়া শুরু হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক কোটি ১২ লক্ষ টাকা। নির্মানকাজ শেষ হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৮৫ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের শহীদ মিনার নির্মান প্রকল্প আনুষ্ঠানিকাভাবে শেষ হয় বলে জানা গেছে।

এই শহীদ মিনার এখনও পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান শহীদ মিনার সম্পর্কে ‘ভাষা-আন্দোলন: ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব’ গ্রন্থে ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘সব মিলে বর্তমান অবস্থায় শহীদ মিনার চত্বরের আয়তন বেড়েছে, ঘাস ও গাছপালা মিলে খানিক সবুজ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, প্রাঙ্গনের আয়তনের সঙ্গে সোপান সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু মূল মঞ্চ ও স্তম্ভ একই থাকার কারণে সব মিলিয়ে কিছুটা আনুপাতিক অসঙ্গতিও যেন তৈরি হয়েছে মনে হয়।’

গবেষকরা মনে করছেন, এখনকার শহীদ মিনার ১৯৬৩-১৯৭১ সাল ও ১৯৭৩-১৯৭৬ সালের শহীদ মিনারের চেয়েও সংকুচিত অবস্থায় আছে। কেননা এখনকার শহীদ মিনারের নীচের কক্ষে কোনো ম্যুরাল নেই।

ভূগর্ভস্থ কক্ষ সম্পর্কে স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, এর আগের শহীদ মিনারের বেজেমেন্টের কক্ষের ম্যুরাল আবহাওয়াজনিত কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর এখনকার শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলোর গাঁথুনি ভুমি পর্যন্ত আছে। তাই স্তম্ভের ঠিক নিচে বেজমেন্টে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। কিন্ত স্তম্ভগুলোর আশেপাশে বদ্ধ কক্ষ আছে বলে জানা যায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের শহীদ মিনারেও শিল্পী হামিদুর রাহমানের নকশা বাস্তবায়িত না হওয়া প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করেই মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারও শিল্পী হামিদুর রাহমানের নকশা বাস্তবায়িত করেনি। প্রতিটি সরকারই হামিদুর রাহমানের নকশা বাস্তবায়নে গাফিলতি দেখিয়েছে। অথচ এটি বাস্তবায়িত করা সরকারের রাষ্ট্রিক ও আদর্শিক দায়িত্ব।’ মূল নকশা মোতাবেক শহীদ মিনার কমপ্লেক্স তৈরি হলে, তাতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যেমন সংরক্ষিত হত। তেমনি পর্যটকদেরও জন্যেও তা আকর্ষণীয় স্থাপত্যে পরিণত হতো বলে তিনি মনে করেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও গড়িমসি

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতা সংরক্ষণে সাত বছর আগে হাইকোর্ট এক নির্দেশনা দিয়েছিলো। তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ভাষাসৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরি, শহীদ মিনারের পাশে একটি লাইব্রেরিসহ ভাষা জাদুঘর নির্মাণের নির্দেশনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ ও অগ্রগতি ছয় মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে সংস্কৃতিসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি রোববার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর মাধ্যমে তারা আসলে মূল নকশার আলোকে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারের পক্ষেই কথা বলেছেন।

২০১০ সালে ভাষাসৈনিকদের স্মরণে স্থাপিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। বিষয়টি চলমান তদারকিতে থাকবে বলেও জানান আদালত।

এরপর হাইকোর্টের দেওয়া আট নির্দেশনার মধ্যে ভাষাশহীদদের তালিকা তৈরি, লাইব্রেরিসহ জাদুঘর নির্মাণসংক্রান্ত নির্দেশনাসহ অর্ধেক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এর ধারাবাহিকতায় ১৯ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আদেশের জন্য আসে।

উচ্চ আদালতের সর্বশেষ নির্দেশনা বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ রায় দিয়েছিলেন। এরমধ্যে যেসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি, তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর অগ্রগতি প্রতিবেদন ছয় মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে সংস্কৃতিসচিবের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :