ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার সর্দাররা

মাহবুব রেজা
 | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১০:১১

ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার মানুষ বিশেষ করে পুরান ঢাকাকে একসময় যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন সেই ঢাকাই সর্দারদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ঢাকা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের সঙ্গে কথা বলে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, ভাষা আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত ঢাকাবাসীর ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে দ্রুত যে নাটকীয়তার উত্থান ঘটে তার পেছনে ভাষা একটা বড় প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মুখের ভাষাকে হরণ করে তার বিপরীতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে তৎকালীন সরকার ও তার কুশীলবরা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা মারমুখী হয়ে রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে জীবনবাজি রাখে । ছাত্রসমাজের এই প্রতিবাদী ভূমিকা সে সময়কার সরকার খুব একটা ভালোভাবে নিতে পারেনি। তারা নানাভাবে এই আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছাত্রসমাজকে দমিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল।

এ সময়ে এগিয়ে আসে পুরান ঢাকার মানুষ। আগে থেকেই পুরান ঢাকার অবস্থাপন্ন বাসাবাড়িতে মেধাবী ছাত্রদের লজিং থাকার একটা ট্রাডিশন চালু ছিল। ঢাকাবাসীর দুটো ধারণা এর পেছনে কাজ করত। এতে করে পড়াশোনায় অনগ্রসর নিজেদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি লজিং থাকা ছাত্রদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ আর্থিকভাবে তারা লাভবান হতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্র তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় লজিং থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেত এবং মাস শেষে কিছু টাকা দেশের বাড়িতেও পাঠাতে পারত বয়সে তরুণ থাকা সত্ত্বেও লজিং থাকা এই ছাত্রদের পুরান ঢাকার সব বয়সী মানুষের কাছে এরা খুব আদব-কায়দা পেতো। তাদেরকে যথেষ্ট সম্মান জানাতেও কসুর করত না তারা। ঢাকার মানুষ শিক্ষকের সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করত না।

লজিং-শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্র কখনো বেয়াদবি করেছে এমন অভিযোগ বাড়ির মুরব্বির কাছে গেলে মুরব্বি ঢাকাইয়া রসবোধে স্বভাবসুলভ ভাষায় কড়া নির্দেশ দিতেন শিক্ষকদের, ছার, আমার পোলা হালায় যদি আপনের লগে কোনো রহমের বগি-চগি (মানে উল্টাপাল্টা) আর বেদ্দবি (বেয়াদবি) করে তাইলে হালারে পিটায়া ওর পিঠের চামড়া দিয়া চপ্পল বানাইবেন, হেরপর হেই চপ্পল পায়ে পিন্দা আপনে ইনভারসিটি যাইবেন। মাগার বেদ্দবি সহ্য করন যাইব না। শিক্ষক হইল গিয়া বাপের মতো আর হেরে করবো অসম্মান! ‘কাভি নেহি-কাভি নেহি’ এরকম একটা মিথ তখন ঢাকাবাসীর মধ্যে চালু ছিল। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের লজিং থাকা সেই শিক্ষকদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রী, উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। দেশ পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

লজিং থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা আলাদা সম্মান আর শ্রদ্ধার জায়গা তোলা ছিল ঢাকাবাসীর হৃদয়ে । তারা মনে করত এসব মেধাবী ছাত্ররা বাবা-মাকে বিদেশে (দূরের জেলা শহরকে তখন গণ্য করা হতো বিদেশ হিসেবেই) ফেলে রেখে কষ্ট করে পড়ালেখা করতে শহরে এসেছে। পড়াশোনা শেষে তারা যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তবে তাদের বাবা-মায়ের স্বপ্ন সার্থক হবে। পুরান ঢাকার দিল দরিয়া মানুষজন দূর জেলা শহরের সেই সব বাবা- মায়ের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা, মানবিকতা, দায়িত্ব এভাবেই পালন করত।

পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে এই মানবিক ব্যাপারটি ভীষণভাবে কাজ করত। মানবিকতায় পুরান ঢাকার মানুষ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের চেয়ে এক কাঠি এগিয়েÑএ রকম কথা প্রচলিত শত শত বছর আগে থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাবা-মা ছেড়ে শহরে পড়তে আসা মেধাবী ছাত্রদের লজিং রেখে তারা মনে করত তারাও নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুত্র-সম ছাত্রদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

দুই.

বছরখানেক আগে কর্মসূত্রে চিত্রশিল্পী ও ভাষা সংগ্রামী মুর্তজা বশীরের ফার্মগেটের বাসায় সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে একসময় ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ আসায় তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার মানুষের ভূমিকা কেমন ছিল।

তিনি তখন আমাকে জানিয়েছিলেন, ষাটের দশকের দিকে তারা পুরান ঢাকার বেগমবাজার এলাকায় থাকতেন। পুরান ঢাকার মানুষজন সবাই তার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে যতটা অধ্যাপক হিসেবে চিনতেন তার চেয়ে তিনি তাদের কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন মৌলবি শহীদুল্লাহ্ সাহেব হিসেবে। শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে নানা কারণে পুরান ঢাকার মানুষজন খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করত। মিলাদ মাহফিল, পরামর্শসহ নানা বিষয়ে এলাকার মানুষজন তার কাছে ছুটে আসত ।

মুর্তজা বশীর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে পুরান ঢাকার উর্দুভাষী কিছু মানুষ শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে তাদের সেই প্রতিরোধ কোনোভাবেই ছাত্রসমাজের বৃহত্তর আন্দোলনের মুখে টেকেনি। বরং তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ভাষা আন্দোলনের জোয়ার যখন তুঙ্গে তখন নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তখন ছাত্রদের আন্দোলনকে দমাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

শুধু তা-ই নয় নুরুল আমিন ও তার তাঁবেদার মুসলিম লীগের নেতারা পুরান ঢাকার স্থানীয় পা-াদের লেলিয়ে দেয় তারা যেন পুরান ঢাকার বাড়িঘরের প্রতি তীক্ষè নজর রাখে। কারণ গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী পুরান ঢাকার অনেক বাড়িঘরে লজিং থাকার নামে অনেক ছাত্র থাকে যারা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। সুতরাং পা-াদের ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় বিষয়টি।

সে সময় আন্দোলনরত অনেক ছাত্র হল ছাড়তে বলায় বেশ অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। যারা আগে থেকে হলে থাকত তাদের মধ্যে এই অনিশ্চয়তার মাত্রাটা বেড়ে যায়। এই অনিশ্চয়তা গিয়ে পড়ে ছাত্রনেতাদের ওপরও। তখন তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়ায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কলেজের ছাত্ররা হল ছেড়ে কোথায় যাবে? কে তাদের আশ্রয় দেবে?

মুর্তজা বশীর জানান, সেই সময় পুরান ঢাকার সর্দারদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তারা যদি সেই সময় ভূমিকা না রাখতেন তাহলে ভাষা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কেমন হতো তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। তবে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধে শাসকদের মনোবল একটু দুর্বল যে হয়েছিল সেটা পরিষ্কার বোঝাই যায় ।

তিন.

ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মদ আজিম বখশ দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন। পুরান ঢাকার সর্দার পরিবারের উত্তরাধিকারী হিসেবে পুরান ঢাকার প্রতি তার রয়েছে এক অন্য ধরনের ভালোবাসা, মমতা। ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার সর্দারদের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানান, রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের কারণে পুরান ঢাকার সর্দাররা মুসলিম লীগের পা-াদের ঘরে ঘরে লজিং মাস্টারদের দেখে নেওয়ার এই হুমকিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। তখন ঢাকার ২২ সর্দারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিলেন কাদের সর্দার।

কাদের সর্দার তখন ফরাশগঞ্জের মাওলা (মওলা বখশ সর্দার এলাকায় পরিচিত ছিলেন মাওলা সর্দার নামে) সর্দার, রহমতগঞ্জের আরেফ সর্দার, হোসেনি দালানের পিয়ারু সর্দারসহ ঢাকা শহরের অন্য সর্দারদের নিয়ে জরুরি সভা করে ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেন। যদিও তখন দু-একজন সর্দার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাদের সর্দারসহ মাওলা সর্দার, পিয়ারু সর্দারের কথা মেনে নেন। পঞ্চায়েতের নেতাদেরও এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়।

সে সময় পুরান ঢাকার সর্দারদের নেতা কাদের সর্দারের পক্ষ থেকে মহল্লার, পঞ্চায়েতের নেতা-কর্মীরা পরিষ্কার ভাষায় মুসলিম লীগের পা-াদের একরকম হুমকি দেয়, তোমরা যদি আমগো মা বইনে গো ঘরের ভেতর গিয়া লজিং মাস্টার গো কিছু কও, ওগো গায়ে হাত তোলো তাইলে কইলাম তোমাগো খবর কইরা ফালামু।

সর্দারদের ‘খবর কইরা ফালামু’ এই হুমকিতে বেশ কাজ হয় উল্লেখ করে আজিম বখশ জানান, মুসলিম লীগের পা-ারাও ভেবেচিন্তে দেখল, এসব ঝামেলায় গিয়ে তাদের লাভ কি? লাভ তো নেতাদের। ভাষা আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের জায়গায় থাকুক আর আমাদের জায়গায় আমরা থাকি। ভাষা আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে আমাগো তো এই বাপ-দাদার পাড়া-মহল্লায়ই থাকতে হইব, নাকি? হুদা হুদা ঝামেলা পাকায়া লাভ কি?

চার.

আমাদের নাগরিক সমাজের কেউ কেউ (সবার কথা বলছি না) নানা কারণে ঢাকার আদি বাসিন্দাদের ব্যাপারে নাক সিটকাতে পছন্দ করেন। দু-তিন পুরুষ ধরে ঢাকায় আবাস গড়া এসব নব্য ঢাকাবাসী পুরান ঢাকার মানুষের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাঁকা চোখে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু এসব নব্য ঢাকাবাসী ভুলে যান যে পুরান ঢাকার মানুষই আসলে ঢাকার প্রাণ।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-মাখা ইতিহাস যে ইতিহাসের পাতায় পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে আছে। বঙ্গভঙ্গ থেকে ভাষা আন্দোলন, তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধÑ দেশ স্বাধীনের পর আজ পর্যন্ত দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রাম সর্বশেষ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্যেও তাদের অপরিসীম অবদান রয়েছে। পুরান ঢাকার মানুষ তাদের সর্বস্ব দিয়ে প্রমাণ করেছেন বুকের ভেতর লালন করা দেশের জন্য ভালোবাসা। মানুষের জন্য ভালোবাসা।

মাহবুব রেজা : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কথাসাহিত্যিক

ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/এমআর/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :