শহীদ দিবসের নাম ঠিকমত লিখতে-বলতে পারছে না অধিকাংশ টিভি

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:২৫

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির জীবনে প্রতিবছর এ দিনটি আসে সংগ্রাম আর আন্দোলনের শক্তিকে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গৌরব ও বেদনার ইতিহাসকে ধারণ করে। দিবসটির একটি আনুষ্ঠানিক নাম আছে- ‘মহান শহীদ দিবস’। অথচ ৬৫ বছর পরে এসেও দেখা যাচ্ছে, দেশের অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল সঠিকভাবে দিবসটির নাম বলতে ও লিখতে পারছে না !

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। দিবসের নামটি খুবই পরিষ্কার- মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। অথচ দেশের সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ এর নাম ঠিকমত লিখতে পারছে না।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের অংশীদারিত্বে পরিচালিত ‘দেশ’ টেলিভিশন চ্যানেল ‘মহান শহীদ দিবস’ এর খবর প্রচার করতে গিয়ে স্ক্রল লাইনে লিখেছে ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ’।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা, দেশের বড় সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মালিকানাধীন ডিবিসি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের স্ক্রল লাইনে লিখেছে, ‘আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

পার্সেল-কুরিয়ার ব্যবসা করা এসএ পরিবহনের মালিকানায় পরিচালিত টেলিভিশন চ্যানেল এসএটিভি লিখেছে, ‘আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

কমবয়সী সাংবাদিকদের দিয়ে পরিচালিত ‘সময়’ টেলিভিশন চ্যানেল লিখেছে, ‘বাঙালির গর্বের অমর একুশে আজ’।

‘সংবাদ নয়, সংযোস’ স্লোগানে পরিচালিত টেলিভিশন চ্যানেল ‘৭১’ তাদের স্ক্রল লিখেছে এভাবে- ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আজ-রাষ্ট্রভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আজ।’

মাহফুজুর রহমানের মালিকানাধীন চ্যানেল এটিএন নিউজ লিখেছে, ‘অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। আওয়ামী লীগপন্থী ব্যবসায়ী নেতা আবুল কালাম আজাদের হামীম গ্রুপের মালিকানাধীন চ্যানেল২৪ তাদের স্ক্রললাইনে লিখেছে, ‘যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

চ্যানেল২৪ শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা লিখেই দায়িত্ব শেষ করেছে। আগে তো নিজেকে ধারণ করতে হবে, তারপর বিদেশকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আমাদের মহান শহীদ দিবস এর ওপর ভিত্তি করে ঘোষিত হয়েছে। আমাদের চেতনা ও ইতিহাস এখন পুরো বিশ্বের মানুষের আর্থ-সামাজিক ও কৃষ্টি বিকাশের মাধ্যম হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।

একসময়ের বিএনপিপন্থী (এখন আওয়ামীপন্থী) চ্যানেল বলে পরিচিত আরটিভি তাদের স্ক্রল লাইনে লিখেছে ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’

তবে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ঠিকভাবেই লিখতে পেরেছে ‘মহান শহীদ দিবস’ এর নামটি । মাহফুজুর রহমানের মালিকানাধীন পুরনো চ্যানেল এটিএন বাংলা লিখেছে, ‘আজ অমর একুশে, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

একসময়ের আলোচিত বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর মালিকানাধীন চ্যানেল এনটিভিও দিবসের নাম ঠিকভাবে লিখেছে। এনটিভি স্ক্রল দিয়েছে, ‘আজ অমর একুশে, মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। চ্যানেল আই লিখেছে, ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী সাহেবের গাজী গ্রুপের মালিকানাধীন গাজী টেলিভিশন লিখেছে, ‘আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।

আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের বৈশাখী চ্যানেল স্ক্রল দিয়েছে- ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ভাষাশহীদ দিবস’। এক অর্থে ঠিকমত লিখলেও বৈশাখী চ্যানেল ইতিহাসের ধারাক্রমের বিবেচনায় ভুল করেছে। ২১শে ফেব্রুয়ারির খবর লিখতে গেলে অবশ্যই আগে লিখতে হবে, মহান শহীদ দিবসের কথা; তারপর আসবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা।

যমুনা গ্রুপের টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভি লিখেছে, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি; মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) অফিসিয়াল নামটি ঠিকমত ব্যবহার করেছে। তারা লিখেছে, ‘আজ অমর একুশে; মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’

২১ শে ফেব্রুয়ারি একটি তারিখ, একটি দিন। এ দিনটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে পালন করছে ‘মহান শহীদ দিবস’ হিসেবে। এর স্মৃতি এবং চেতনা একই সাথে গৌরব ও শোকের। বলা যায় দিবসটি গৌরবময় বেদনার। বীর বাঙালি ‘মহান শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করেছিল সেই ১৯৫৩ সাল থেকেই। মূলত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও চেতনাই পরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অন্যতম বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এ দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এরপর কত ঘটনা-দুর্ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশ টিকে আছে। কিন্তু যেদেশের এতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল জাতীয় দিবসের নামই এখন পর্যন্ত ঠিকমত লিখতে পারে না, সেদেশের টিকে থাকা কেমন হতে পারে সবাই নিজেরাই একটু ভেবে নেন।

জগতে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটকের কাজ করেছিল মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন সাহসী যুবক সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। অথচ, ৬৫ বছর পর স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে সেই বিশেষ দিবসের আনুষ্ঠানিক নামটিও ঠিকমত লিখতে বা বলতে পারে না এদেশের অধিকাংশ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। টেলিভিশন চ্যানেল তো গণমাধ্যম। গণযোগাযোগের এ মাধ্যমকে সমাজের প্রকৃত কৃষ্টি বিকাশে কাজে লাগানোর কথা আমাদের নীতি নির্ধারকদের। কিন্তু যারা একটা জাতীয় দিবসের নামই ঠিকমত লিখতে পারে না, তাদের লইয়া জাতি কী করিবে! আর যারা ঠিকমত লিখতে পেরেছে তাদেরকে অতি প্রশংসা করারও কিছু নেই। নিজেদের একটা ভালো প্রোগ্রাম নেই। শুধু ভিডিও ফুটেজ, বিজ্ঞাপন আর টক শো দেখিয়ে আর কতদিন? মানুষতো এগুলো দেখতে চায় না।

লেখক: শেখ আদনান ফাহাদ, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :