ফটো আপার বৃদ্ধাশ্রম

জাভেদ হোসেন, গাইবান্ধা
 | প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৯:৪৬

নাম সুলতানা শামীমারা বেগম। বয়স বায়ান্ন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। তবে এলাকায় তিনি ফটো আপা নামেই বেশি পরিচিত। পেশায় তিনি শিক্ষক হলেও নেশা তার বৃদ্ধাদের সেবা।

মানবতার সেবায় ব্যাকুল ফটো আপা প্রতিদিন সকালে বেড়িয়ে পড়েন। পাড়া-মহল্লায় গিয়ে অসহায় বৃদ্ধাদের খোঁজ-খবর নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের সমস্যার কথা শোনেন। গল্পের ফাঁকে বৃদ্ধাদের মাথায় তেল ও আঁচড়িয়ে চুলে বেনি করে দেন। তাদের চাহিদা সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি।

ফটো আপার এই উদ্যোগে এ পর্যন্ত প্রায় ১শ বৃদ্ধা উপকৃত হয়েছেন। উপকারভোগী বৃদ্ধাদের নিয়ে সাপ্তাহিক বৈঠকও করেন তিনি। এভাবেই নয় বছর ধরে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন ফটো আপা।

গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা সদর ইউনিয়নের কচুয়াহাট গ্রামে ফটো আপার বাড়ি। শামীমারা বেগমের বাবা শামছুজ্জোহার ইচ্ছে ছিল মেয়ে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে। কিন্তু ফটো আপা চিকিৎসক হতে পারেননি। এরপর শামীমারা কিছু একটা করার কথা ভাবতে থাকেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি বৃদ্ধা নারীদের কল্যাণে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন সকালে পাড়া-মহল্লায় গিয়ে অসহায় বৃদ্ধাদের খোঁজ নেন। তারপর যার যেমন চাহিদা, সে অনুযায়ী সমাধান করে দেন।

বিশেষত যার স্বামী নেই, ছেলে-মেয়েরা ভাত-কাপড় দেন না, কিংবা থাকার জায়গা নেই- এমন বৃদ্ধাদের চিকিৎসায় নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দেন তিনি। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অনুরোধ করে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি কার্ড পাবার ব্যবস্থা করে দেন।

২০০৭ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন বৃদ্ধাকে সহায়তা করেছেন ফটো আপা। সহায়তা দেয়ার পর তারা কেমন আছেন, তা তদারকি করতে বৃদ্ধাদের সঙ্গে সাপ্তাহিক বৈঠকে মিলিত হন।

শামীমারা বেগম বললেন, আমার কলেজশিক্ষক স্বামীর টাকায় সংসার চলে। আর নিজের বেতনের টাকা বৃদ্ধা নারীদের পেছনে ব্যয় করছি।

এদিকে ফটো আপার সহায়তায় উপকৃত হয়েছেন কচুয়াহাট গ্রামের মনোয়ারা বেগম। তিনি বললেন, ‘হামার সোয়ামি ও একন্যা ব্যাটা আচিল। তামরা মরি গ্যাচে। মানসের বাড়িত কামকরি দুই নাতিক নিয়া চারজনের সোংসার চলাচি। হামার দুকের কতা শুনি ফটোক আপা বিদুবা (বিধবা) ভাতার কার্ড করি দিচে।

একই গ্রামের সত্তর বছর বয়সী আছিয়া বেগমের স্বামী আলেক শেখ মারা গেছেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ছেলেও বিয়ের পর পৃথক খায়। বাধ্য হয়ে আছিয়া বেগম ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে পড়েন।

আছিয়া বেগম বললেন, ‘ফটোক আপা হামার মেয়ে ছোলট্যাক বুঝিয়া তার বাড়িত পাঠে দ্যান। তকন থাকি জামাইয়ের বাড়িত থাকপ্যার নাগচি। আর ভিক্ষা করান নাগে না।’

ওই গ্রামের কত্তুরি বেগম (৭২) বললেন, ‘হামার সোয়ামি নাই। তিনট্যা বেটি আচিলো। তামার ঘরোক বিয়া দিচি। তামরা ঢাকাত চাকরি করে। হামার খবোর ন্যায় না। তাই হামরা গায়োত ভিক্কা করি। ফটোক আপা হামাক কয়- ভিক্কা করা ভালো নোয়ায়। তাঈ ট্যাক্যা দিয়া সাহায্য করব্যার নাগচে।

অপরদিকে শামীমারা বেগম নিজের টাকায় বাড়ির পাশে ধনারুহা গ্রামে এগার শতক জমি কিনেছেন। ওই জমিতে প্রায় ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে টয়লেটসহ ২২ হাত আধাপাঁকা ঘর নির্মাণ করেন। ২০১৩ সালে এখানে গড়ে তোলেন বৃদ্ধাশ্রম। নাম দেন ডা. শামছুজ্জোহা মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রম।

জানতে চাইলে কচুয়াহাট গ্রামের ইউপি সদস্য মজদার রহমান বলেন, যে কাজ জনপ্রতিনিধির করার কথা- সে কাজ ফটো আপা করছেন। এজন্য আমরা সবসময় তাকে উৎসাহ দেই।

সাঘাটা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, অসহায় বৃদ্ধাদের জন্য তিনি দৃষ্টান্ত। তার প্রচেষ্টায় বৃদ্ধারা উপকৃত হচ্ছে। তাকে অনুপ্রেরণা যোগানোর পাশাপাশি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।

শামীমারা বেগম বললেন, বয়স বেশি হলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের কাছে অনেকটা অবহেলিতও হন। তাই বৃদ্ধাদের জন্য কাজ করছি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে বৃদ্ধা নারীদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছি না।

সুলতানা শামীমারা বেগম ১৯৮০ সালে মাধ্যমিক, ১৯৮২ সালে উচ্চমাধ্যমিক এবং ২০১২ সালে স্নাতক পাস করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের সাতদিন পর কচুয়াহাট শহীদ এইচআরএম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল সাঘাটা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে রাজসি সুলতানা অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং ছেলে জারিফ রাজ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

বৃদ্ধাদের সহায়তার পাশাপাশি তিনি বাল্যবিয়ে রোধ, গ্রামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং সামাজিক কাজের জন্য জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তেরটি পুরস্কার পেয়েছেন।

(ঢাকাটাইমস/২৫ফেব্রুয়ারি/আঞ্চলিক প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :