পরিবহন ভোগান্তি, দায় নিচ্ছে না কেউ

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ মার্চ ২০১৭, ০০:১০ | প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২০:৫৮

হঠাৎ পরিবহন ধর্মঘটে বিপাকে পড়েছে দূরপাল্লার যাত্রীরা। বিভিন্ন টার্মিনালে আটকা পড়ে অনেক যাত্রী। পরিবহনের অভাবে হেঁটে কিংবা নানা বিকল্প ধরে গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু সংকট সুরাহার কোনো দায় দেয়া যাচ্ছে না শ্রমিক, মালিক কিংবা সরকার পক্ষে।

শ্রমিকরা বলছেন, আদালতের রায় প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা গাড়ি চালাবেন না। পরিবহন মালিকরা বলছেন, এ ব্যাপারে কিছু করার নেই তাদের। তারা তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে। সরকারের সড়ক পরিবহনমন্ত্রী শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ধর্মঘট প্রত্যাহারের। কিন্তু ধর্মঘট প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণ নেই কোথাও।

চরমোনাইয়ের মাহফিল শেষ করে ২০ জনের একটি দল নিয়ে রফিকুল ইসলাম লঞ্চে সদরঘাট এসেছেন মঙ্গলবার সকালে। সেখান থেকে মহাখালী বাস টার্মিনালে আসেন টাঙ্গাইল যাবেন বলে। এসে শুনতে পান পরিবহন ধর্মঘট চলছে। সকাল থেকে বাস টার্মিনালে বসেন আছেন ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণার আশায়। কিন্তু বেলা তিনটা পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যাওয়ার সন্ধানে নামেন তিনি।

ঢাকাটাইমসকে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একসঙ্গে আমরা বরিশালের চরমোনাইয়ের মাহফিলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ঢাকায় এসে এখন ভোগান্তিতে পড়লাম। আগে এটা জানা থাকলে রওয়ানা দিতাম না। এখন কীভাবে বাড়ি যাব বুঝতে পারছি না।’

রফিকুল ইসলামদের সবার সঙ্গে ভারী ব্যাগ। সেগুলো মাথায়-কাঁধে-পিঠে তুলে তারা লাইন ধরে হাঁটা ধরলেন মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের দিকে।

হেঁটেই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবেন কি না জানতে চাইলে রফিকুল বলেন, ‘দেখি চলতে চলতে যদি কোনো ব্যবস্থা হয়।’

আশি বছরের সাবেরা খাতুন যাবেন রংপুরে। চোখেমুখে হতাশার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সামনে যাকেই পাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করছেন কীভাবে রংপুর যাওয়া যাবে। নাতিকে নিয়ে সোমবার ঢাকায় এসেছিলেন একটা কাজে। কাজ শেষে এখন আর বাড়ি যেতে পারছেন না পরিবহন ধর্মঘটের কারণে।

রিকশায় মালামাল বোঝাই করে মহাখালী এসেছেন হাবিবুর রহমান। যাবেন সিলেট। কোনো ঘোষণা ছাড়াই বাস চলাচল বন্ধ হওয়াই বিপাকে পড়েছেন তিনি। মালামাল নিয়ে এখন রাস্তায় বসে থাকতে হবে, নয়তো বাসায় ফিরে যেতে হবে। তিনি বলেন, আগে জানলে এই কষ্টটা হতো না। ‘সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায়- এটা কেমন কথা’ বলে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি।

রুবানা ইসলাম তার অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছেন। তিনি যাবেন চট্টগ্রাম। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছেন না।

সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় আদালতে চালকের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে এভাবেই মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। এই দুর্ভোগ আরো বাড়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

মঙ্গলবার মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, টার্মিনাল থেকে আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল পর‌্যন্ত সারিবদ্ধ নিথর বাস। টার্মিনালের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে বাসের অপেক্ষা করছেন যাত্রীরা। আবার কেউ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন কোনো বাস ছাড়ে কি না দেখতে। বাসের কাউন্টারগুলো ফাঁকা। দু-একটি কাউন্টারে লোক দেখা গেলেও তারা সেখানে অলস সময় কাটাচ্ছেন।

টর্মিনালে কথা হয় বাসচালক রিপনের সঙ্গে। তাদের কথা, দুর্ঘটনা মামলায় আদালতে শাস্তি প্রত্যাহার না করা পর‌্যন্ত তারা বাস চালাবেন না। এমনকি বাস চালানো ছেড়ে দেবেন।

রিপন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাই। আমরা জনগণের সেবা করি। আর আমাদেরই কি না ঘাতক বলা হয়। এটা কেমন কথা।’ মালিককে গাড়ির চাবি দিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে এই চালক বলেন, ‘প্রয়োজনে গ্রামে গিয়ে মাটি কেটে খাব।’

দেশের রাস্তার বেহাল অবস্থা আর পথচারীদের অসচেতনতার কথা তুলে ধরে রিপন দাবি করেন, ‘তারা অনেক সাবধানে গাড়ি চালান। কোনো চালকই ইচ্ছে করে কাউকে মারে না। রায় স্থগিত না করা পর্যন্ত কোনো চালক গাড়ি চালাবেন না।’

দায় নিচ্ছে না পরিবহন মালিকরা

চলমান পরিবহন ধর্মঘটের কোনো দায় নিচ্ছে না পরিবহন মালিকরা। তারা বলছেন, এটা একান্তই শ্রমিকদের ব্যাপার। তবে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে তারা চেষ্টা করছেন বলেও দাবি করেন তারা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা তো কোনো ধর্মঘট ঢাকিনি। গতকাল রাতে বাসচালকরা এসে মালিকদের চাবি জমা দিল। আজ তাদের বাসটার্মিনালে দেখা যাচ্ছে না।

একজন চালকের ফাঁসির রায়ের খবরে হঠাৎ করেই এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে বলে দাবি করেন আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘এখন ডিজিটাল যুগ। সোমবার এক ড্রাইভারের ফাঁসির রায়ের পর সেটা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের চালকদের মাঝে। গতকাল রাত সাড়ে ১২টা পর থেকেই তারা বাস চালানো বন্ধ রেখেছে। আজ সকালে সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।’

আবুল কালাম আরো বলেন, ‘আমরা যারা গাড়ির মালিক, সবাই চাই গাড়ি যেন চলে। বেশির ভাগ গাড়ির মালিকই ঋণগ্রস্ত। কিন্তু ড্রাইভাররা গাড়ি না চালালে আমরা কী করব। তবে আমরা চেষ্টা করছি তাদের ফিরিয়ে আনতে।’

কিন্তু চালকরা এখন কোনো দুর্ঘটনায় মালিকের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা ও তাদের পরিবারের দায়ভার নেয়ার নিশ্চয়তা চাইছে বলে বলে জানান ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। শ্রমিকরা এ জন্য মালিক-শ্রমিক চুক্তি চায়। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এটা মানা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব বিষয়টি সমাধানের জন্য।’

পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যেই সকাল থেকে ঢাকায় সিটি সার্ভিসের বাসগুলো নিয়মিত চললেও বিকেলের দিকে তা কমে আসে। ফলে দুর্ভোগে পড়েন অফিসফেরত যাত্রীরা।

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত মামলায় মানিকগঞ্জের আদালতে একজন বাসচালকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে বাস ধর্মঘট পালন করছিলেন খুলনাসহ কয়েকটি অঞ্চলের শ্রমিকরা। সরকারি পর‌্যায়ে বৈঠকের পর সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সোমবার। ওই বৈঠকের সময় আসে সাভারের একটি সড়ক দুর্ঘটনায় এক নারীর মৃত্যুতে ট্রাকচালকের মৃত্যুদণ্ডের খবর। এরপর কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা।

সাভারের ওই দুর্ঘটনা মামলায সোমবার ঢাকার জজ আদালত মীর হোসেন নামের একজন চালকের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

(ঢাকাটাইমস/২৮ফেব্রুয়ারি/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :