ভোগান্তির অপর নাম হবিগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস

পাবেল খান চৌধুরী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ মার্চ ২০১৭, ১৫:৫৩ | প্রকাশিত : ০১ মার্চ ২০১৭, ১০:২১

সারাদেশের মতো হবিগঞ্জেও গত শনিবার থেকে পালিত হচ্ছে পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ ২০১৭। সেবার সপ্তাহেও যেন ভোগান্তির শেষ নেই। দপ্তরটিতে সেবার চেয়ে ভোগান্তিই বেশি বলে অভিযোগ করেন সেবা গ্রহীতারা। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তহীন ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। ফলে ভোগান্তির অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস।

বর্তমানে দপ্তরটি দালাল ও অফিসের অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দখলে। গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন, এখানে দালাল বা মধ্যস্বত্ত্বভোগী ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আর ভেতরে ঢুকলেও নানা অজুহাত শুনতে হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন, জন্মনিবন্ধন সনদ ও সত্যায়িত করার সিল সবই এখন আছে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। দরকার শুধু টাকা। পকেট টাকা ঢুকিয়ে দিলেই দ্রুত হয়ে যায় পাসপোর্ট প্রস্তুত। আর না দিলে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। দালাল ছাড়া সাধারণ গ্রাহকরা নিয়মানুসারে আবেদন করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পাচ্ছেন না তাদের কাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট সেবা।

হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের প্রতিদিনকার খুবই পরিচিত চিত্র এটি। চলতি সপ্তাহে পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ চললেও সেবার মান যেন কিছুতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যেখানে বর্তমান সরকার সাধারণ উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে সাধারণ মানুষ যেন স্বল্প সময়ে পাসপোর্ট সেবা পেতে পারে এর জন্য মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। স্বল্প সময়ে পাওয়ার বিপরীতে উল্টো দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। আগের তুলনায় সেখানে বেড়েছে হয়রানি, দুর্নীতি ও ভোগান্তি। আর এর বেশির ভাগই ঘটে নিজ হাতে আবেদন ফরম জমা দিতে গেলে।

এনালগ পদ্ধতি থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে নিত্য-নতুন স্টাইলে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের। যেসব গ্রাহক নিজে আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে যান তাদের ক্ষেত্রে শুরু হয় অজুহাতের নানা ঝুলি। হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক যাচাই-বাছাইয়ের নামে তাদের পূরণকৃত ফরম সঠিক হলেও নানান ছুঁতোয় ভুল ধরে ফিরিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। অথচ একই ফরম কিছক্ষুণ পর কতিপয় দালালের মাধ্যমে পাঠানো হলে তাতে কোনো ভুল থাকে না বা ভুল ধরে না কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে অভিযোগ করেন একাধিক সেবা গ্রহীতা।

একটি সূত্র জানায়, দালালদের মাধ্যমে জমাকৃত প্রতিটি পাসপোর্টের গায়ে বিভিন্ন সংকেত দেয়া থাকে যা তারা সহজেই বুঝে নিচ্ছেন এটি কার জমা। জমার পর অফিস শেষে কোনো এক সময়ে পৌঁছে দেয়া হয় অফিস খরচ নামে কর্মকর্তাদের ভাগের টাকা। গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্করা জাতীয় পরিচয়পত্র আর অপ্রাপ্তবয়স্করা জন্মনিবন্ধন দেবেন। এরপর আবেদনপত্র দুটি সত্যায়িত করতে হয়। কিন্তু ফরমে ছাপানো এ নিয়মও মানছে না হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। সেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি সত্যায়িত করে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। তাদের নিয়মানুসারে সত্যায়িত ফটোকপি নিলেও এই জন্ম নিবন্ধনের কপি রাখা হচ্ছে না। কোনো কারণে তা জমা হলে পরবর্তী সময়ে পাসপোর্ট নিতে গ্রাহকরা অফিসে গেলে তাদের জানানো হয় আপনার পুলিশ রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। পুলিশ রিপোর্ট ম্যানেজ করে তারপর আসেন। এরকম নানা অজুহাতে সেবা নিতে আসা লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে দিনের পর দিন। আর দালালদের একটি চক্র ওই অফিসের সামনে এবং আশেপাশে রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি বানিয়ে বসেছে। এ তালিকায় আবার কয়েকজনকে ভিআইপি হিসেবে বলা হয়ে থাকে।

কোথাও কোথাও তারা ছোট আকারে দোকানপাট ও ট্রাভেলস খুলে বৈধতার খোলসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ও আবেদনের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার পরও বন্ধ হচ্ছে না হয়রানি। দালাল মারফত নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। প্রতিটি অর্ডিনারি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন হাজার টাকা, জরুরি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, অতিরিক্ত টাকার মধ্যে পাসপোর্ট অফিস নিচ্ছে ৯০০, পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য হবিগঞ্জ পুলিশের জেলা বিশষে শাখা (ডিএসবি) অফিসে যাচ্ছেন ৭০০ থেকে এক হাজার আর বাকি টাকা যাচ্ছে দালালদের পকেটে। ওই তিনের সমন্বয়ে পাসপোর্ট অফিসে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুরাতন পাসপোর্ট অফিস স্থানান্তর করে হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের কম্পাউন্ডারের পাশে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন অনিয়ম ও সাধারণ গ্রাহকদের দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে অফিসটি স্থানান্তর করলেও খোদ পুলিশের চোখের সামনেই বাড়ছে গ্রাহকদের ভোগান্তি ও দালালদের উৎপাত।

সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের অভিযোগ, পাসপোর্ট অফিসের সহাকারী পরিচালক, দায়িত্ব পালনরত আনসার সদস্য, পুলিশ ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা ও ওই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশে দালালরা কাজ করছে। আর এই দালালির কাজে নিয়োজিত রয়েছে, হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ট্রাভেলস এজেন্সি, অফিসের কতিপয় কর্মচারী ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্তরালের কিছু লোক।

অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ ট্রাভেলস এজেন্সি খুলেছে পাসপোর্ট অফিসের দালালরাই। আবার কেউ কেউ ফটোস্ট্যাট, স্টুডিও খুলেছে। নিয়মানুযায়ী ট্রাভেলস এজেন্সিগুলো ভিসা বা টিকিটের কার্যক্রম চালানোর কথা থাকলেও বাস্তবে ভিসা বা টিকিটের কাজের চেয়ে পাসপোর্টের ফরম পূরণ ও স্টুডিওর ব্যবসা।

অভিযোগ রয়েছে, ট্রাভেলস এজেন্সিগুলোর দালালরা নিজেরাই প্রথম শ্রেণির গেজেটেট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর নকল করে ও সিল তৈরি করে ফরম ও ছবি সত্যায়িত করে দিচ্ছেন। আর এর জন্যও নিচ্ছেন অতিরিক্ত আরও ১০০ থেকে দেড়শ টাকা। তবে দালালদের মাধ্যমে আয়কৃত টাকার একটি বৃহৎ অংশ চলে যাচ্ছে প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দপ্তরে, কতিপয় সাংবাদিক ও গুটিকয়েক রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দালালরা যাদের স্বাক্ষর ও সিল নকল করে সত্যায়িত করছে তারা অনেকেই হবিগঞ্জে কর্মরত নন, কিংবা এক সময় কর্মরত ছিলেন, এখন নেই। এই সত্যায়িতগুলো তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই উল্লিখিত ভাগের টাকা পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিচ্ছেন। একের পর এক অনিয়মের শিকার হলেও এসবের প্রতিবাদ করতে সাহস করতে পারছে না সাধারণ গ্রাহকরা। যদি কেউ ভুল করে প্রতিবাদ করেন, তবে তাকে নানা ধরনের হেনস্থা হতে হচ্ছে।

অপরদিকে গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হবিগঞ্জ পুলিশের বিশেষ শাখা ডিএসবিতে। ডিএসবিতে কর্মরত কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য গ্রাহদেরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেয়ার নামে দাবি করে বসেন এক পাসপোর্টের চালান সমান টাকা। গ্রাহকদের অনেকটা জিম্মি করেই তারা ওই টাকা আদায় করে থাকেন বলে অভিযোগ করেন সেবা প্রার্থীরা।

তারা আরও অভিযোগ করেন, যেকোনো প্রার্থীর নামে মামলা থাকলে তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়ার নিময় থাকলেও তারা প্রতিবেদন না দিয়ে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখেন অফিসে। পরে তাদের সাথে প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলেই কর্মকর্তারা দাবি করে বসেন উৎকোচের। আর তাদের দাবি অনুযায়ী উৎকোচ দিলেই পাঠিয়ে দেন ক্লিয়ারেন্স। এক কথায় টাকা দিলে দ্রুত মিলে ক্লিয়ারেন্স আর না দিলে ঝুলে তাকে দিনের পর দিন।

অন্যদিকে বৈধ হোক আর অবৈধ হোক ফরম জমা করতে গেলেই দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা বিনা রশিদে জমা দিতে হচ্ছে দালালদের হাতে। দালালদের রয়েছে চ্যালেন ফি নামে সাংকেতিক চিহ্ন। আর এ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকে আবেদন ফরমের এক কোনায় খুব ছোট করে। সরকারিভাবে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। অফিসের লোকজন অন্যকারো পক্ষে যা বোঝার কোনো উপায় নেই।

কয়েকজন ভুক্তভোগী আরও অভিযোগ করেন, আমরা সরকারকে নির্ধারিত ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে পাসপোর্ট ফরম জমা দিতে যাই। কিন্তু অজুহাত দেখিয়ে বিনা রশিদে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। চ্যানেল ফির টাকা না দিলেই ফরমে বিভিন্ন খাত বের করা হচ্ছে। ভুল ধরা হচ্ছে একাধিক তথ্যে তবে দালালের মাধ্যমে জমা দিলে সব ভুলই সঠিক। এটা কোনো ধরনের সরকারি নিয়ম-প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের।

একটি সূত্র জানিয়েছে, কোনো ঝুট-ঝামেলা ছাড়া দ্রুত পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়ার আশা দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব দালাল। আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি এড়াতে সাধারণ মানুষও অনেকটা বাধ্য হয়ে এসব দালালের দ্বারস্থ হচ্ছেন। আর এ টাকার একটি বৃহৎ অংশ চলে যাচ্ছে পুলিশ, প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দপ্তরে ও গুটিকয়েক রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে।

পুলিশ ভেরিফিকেশনে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জেলা বিশেষ শাখার (ডিআই-১) শাহ মো. গোলাম মর্তুজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, এ ধরনের কোনো রিপোর্ট আমার জানা নেই। ক্লিয়ারেন্সে বা পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে আমার অফিসে কেউ টাকা পয়সা নেয় না। আমরা পাসপোর্টের আবেদনকারীর সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দিই। এখান থেকে কোনো প্রতিবেদন দেয়া হয় না। থানা থেকে যদি নেগেটিভ, পজেটিভ যা আসে আমরা তা উল্লেখ করে পাঠিয়ে দিই। বিদেশে অবস্থানকারী বা গমনকারীদের ক্ষেত্রে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সেও কোনো টাকা পয়সা নেয়া হয় না। যারা এমন অভিযোগ করেছে তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার কাছে এমন কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের বিয়ষে তিনি বলেন, ‘এতে আমার কিছু বলার নেই। এ বিষয়টি ডিএসবি দেখে। ক্লিয়ারেন্সের সময় তারা কোনো টাকা পয়সা নিলে সেটা দেখবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট দেয়ার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।’

তিনি নিজে দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি সব সময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্ছার ছিলাম, এখনো আছি। অফিসের কেউ এমন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর দালাল যদি থেকেও থাকে সেটা অফিসের বাহিরে হয়তো থাকতে পারে। আমার অফিসের সীমানার ভেতরে দালাল প্রবেশ নিষেধ। অফিসের বাইরে কে কী করছে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার নয়।’

(ঢাকাটাইমস/০১মার্চ/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :