প্রিয় নারী জীবন

সায়মা রহমান তুলি
 | প্রকাশিত : ০৮ মার্চ ২০১৭, ১২:৩৯

‘জীবন’ সৃষ্টিকর্তার এক মূল্যবান উপহার। একটাই জীবন আর এ জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে মানুষ চেষ্টা চালায় নিরন্তর। মানুষ তার মনের মতো করে, তার ভাল লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে সুখী জীবনের প্রত্যাশা করে। জীবন সবার জন্যই যুদ্ধ, হোক সে নারী বা পুরুষ। দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে নারী প্রাচীনকাল থেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শোষিত হয়ে আসছে।

নারীর জীবনকে কিছু ছকবাধা ফ্রেমে আটকিয়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে যুগে যুগে। যে নারীর গর্ভ থেকেই জন্ম নেয় নতুন আরেক মানব সন্তান, যে নারীর হাত ধরে শুভ সূচনা ঘটে কৃষির যে নারীর বুদ্ধিমত্তায় জয়লাভ হয় যুদ্ধে, যে নারীর ভালবাসায় টিকে আছে সভ্যতা সে নারীর জীবন তাহলে দুর্বিষহ কেন? এ প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় আমাদের সবার জানা। ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক প্রথা, এর চেয়েও বড় বিষয় হল নারীর মুক্তচিন্তায় বাধা দেওয়া।

ভারতীয় উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথা হোক আর আজকের কর্পোরেট যুগে কম্প্রমাইজ প্রথা সব প্রথাই মূলত নারী শোষণের হাতিয়ার। আমাদের দেশে একজন নারী সে শিক্ষিত হোক অশিক্ষিত হোক, কর্মজীবী হোক আর গৃহিণী হোক তাকে শোষণ করছে কিছু প্রশ্ন যা প্রথা নয় বরং নারী জীবন কে দুর্বিষহ করার বিষবাষ্প।

একজন নারীর বয়স, উচ্চতা, গড়ন, শিক্ষা, চাকুরী, বেতন, বিবাহ, সন্তান ধারন সর্বোপরি তার জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে চারপাশের মানুষের কড়া নজরদাড়ি ও প্রশ্ন নারীকে তার জীবনের প্রতি অতৃপ্ত করে তোলে। নারী ভাবতে শুরু করে কেবল æনারী” বলে জন্মেছে বলে তাকে এসব কথা শুনতে হচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা বেকার সমস্যা। সরকারি কোন চাকুরীর জন্য একজন চাকুরী প্রার্থীকে ২ থেকে ৫ বছর ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করতে হয়। ৫ বছর পরও চাকুরী হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এ দীর্ঘ সময়ে একজন বেকার নারী পরিবার ও সমাজে টিকে থাকতে যে মানসিক যুদ্ধে লিপ্ত হয় তা একজন নারীর জন্য অমানবিক, কেবল নারী বলেই সমাজ তাকে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে- বলে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।

আগে ক্যারিয়ার পরে বিয়ে, বিষয়টি বাংলাদেশী নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এদেশে ২৫ বছর বয়সের পর থেকে নারীকে পাত্রী হিসেবে বয়সের দিক থেকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ভাবা হয়। অথচ একজন পুরুষ অনায়াসে ৪৫ বছর বয়সে ২০ বছরের নারীকে তার আর্থিক সক্ষমতার জোরে বিয়ে করতে পারে। বলা হয় æছেলেদের আবার বিয়ের বয়স কি?”

নারী যখন বিবাহের পাত্রী তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তার বয়স, উচ্চতা, গড়ন, সৌন্দর্য, শিক্ষা, কিছু ক্ষেত্রে কত বেতনের চাকুরী করে তা। এসব মাপকাঠির আলোকে একজন নারীকে পজিটিভ নেগেটিভ মার্কিং করার পর পাত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে পাত্রপক্ষ এবং কারণ খুব হাস্যকর থাকে। যেমন বলা হয় æমেয়ের সব ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ে খাটো চলবে না”।

আবার, ‘‘মেয়ের সব ঠিক আছে, মেয়ে অনেক মোটা বা কম শিক্ষিত বা কম বেতনের চাকুরী করে ইত্যাদি”। বিবাহের ইন্টারভিউতে মেয়ে রাঁধতে জানে, ধর্ম-কর্ম জানে, সাংসারিক কাজ জানে, গান জানে এসব প্রশ্ন করা হয়। কেউ কখনো জানতে চায় না মেয়েটার শখ কি।

সে কি বই পড়তে ভালবাসে নাকি ভ্রমন ভালবাসে, সে কি সাতার জানে, নাকি গাড়ি চালাতে জানে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী ‘কি জানে’ তা একটি বিরাট বিষয়। যখন একজন নারীকে বলা হয় তুমি সেলাই, গান, নাচ, রান্না জানো? তখন নারীর মনে স্বভাবতই চিন্তা হয় ‘কিছু কেন জানতে হবে”?

কেবল নারী বলে? কখনো কখনো প্রশ্ন জাগে পাত্র, অর্ধাঙ্গী খুঁজছে নাকি বাসার কাজের লোক খুঁজছে? একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে। নারী মাত্রই মমতাময়ী এবং সে তার দায়িত্ববোধ থেকেই ঘরের কাজ করে থাকে। কিন্তু যখন এ স্বাভাবিক বিষয় গুলো ছকবাঁধা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় যোগ্যতা বিচারের ঠিক তখনই নারী তার æনারী জীবন” কে চিহ্নিত করে আলাদাভাবে।

নারী জীবন নিয়ে প্রহসন চলে আমাদের সমাজে। যারা মাটি দিয়ে, অলংকার দিয়ে নারীমূর্তি তৈরি করে পূজো অর্চনার মাধ্যমে কল্যাণ প্রার্থনা করে আবার তারাই কন্যা শিশুর ভ্রুন হত্যা, যৌতুকের জন্য খুব নির্যাতন চালায় নারীর উপর।

একজন নারী যখন শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় নারী তখন তার নারী জীবনকেই দায়ী করে। নিরাপদে চলতে না পারা, পথে ঘাটে নিশ্চুপ শারীরিক নির্যাতন, অপমান, অবহেলার শিকার হয়ে নারী, তার নারী জীবনকে দায় বলে মনে করে।

একজন নারী কন্যা, বোন, স্ত্রী, মা, সহকর্মী, বান্ধবী তার প্রত্যেকটা অবস্থান থেকে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করে। অনেকসময় নিজের সুখ শান্তির কথা চিন্তা না করে জীবনটা অন্যদের সুখে বিলিয়ে দেওয়াকে স্বাভাবিক বলে মনে করে।

স্বামী পরিত্যক্তা, ডিভোর্সী বা বিধবা নারী তার সন্তানের সুখ চেয়ে দ্বিতীয় বিবাহ থেকে দূরে থাকে। নিজের জীবন ভবিষ্যত চিন্তা না করে কেবল সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে উপার্জন করে এবং সেই নারীই শেষ বয়সে নিজ সন্তানের অবহেলার পাত্রী হিসেবে পরিগণিত হয় এবং তার জীবন আত্মত্যাগ এর কথা ভেবে চোখের জল ফেলে, তখন তার আর কিছু করার পথ থাকে না।

স্বামীর সুখ নিজের সুখ, স্বামীর পছন্দ নিজের পছন্দ এমন স্ত্রী পুরুষ মানুষ স্বভাবতই পছন্দ করে থাকে। নারী ভুলে যায় যে তার নিজের কোন পছন্দ অপছন্দ আছে। স্বামীকে খুশি রাখতে লহ্মীবউ হিসেবে নিজের কদর বাড়াতে চায়।

বিবাহিত নারীর কাছে তার দিনের শেষে স্বামীর সোহাগ, সারাদিন শ্বশুড়-শাশুড়ি ও পরিবারের অন্যদের কাজের ফরম্যাস খাঁটা এবং সুনিপুনভাবে নিজের জীবনকে চার দেয়ালে বন্দী রেখে সংসার জীবন অতিবাহিত করাকে আমাদের দেশে আদর্শ নারীর প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়। ইদানিং শিক্ষিত সমাজে চাকুরীজীবী নারীর কদর বেড়েছে।

এমন কিছু স্বামী আছে যারা স্ত্রী বেতন পাওয়া মাত্র তার টাকা কেড়ে নেয়। এ সময় প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক নারীই স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়।

কর্মক্ষেত্রে নারী যে সব সময় খুশি তা নয়, অনেক গৃহিণীদের ধারণা কর্মজীবী জীবন সুন্দর। আর্থিক স্বাবলম্বী নারীরা কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের টিজিং, পলিটিক্স সব সহ্য করেই টিকে থাকে। একজন নারীকে তার পরিবারের সদস্যদের যেমন খুশি রাখতে হয় তেমনি কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজের মাধ্যমে টিকে থাকতে হয়। শ্রমিক শ্রেণির নারীদের নারী বলে কম মজুরি পাওয়ার অভিযোগ বরাবরই রয়েছে।

মা হিসেবে একজন নারী তার সন্তানকে সবার চেয়ে ভাল করে গড়ে তোলার প্রতিযোগিতার নামে। কোনক্রমে সন্তান ব্যর্থ হলে সব দোষ মায়ের দিকে বর্তায়। রান্না-বান্নার নতুন রেসিপি আর সাজগোজের মাঝে শান্তি খুঁজে অনেক নারী। প্রতিযোগিতা করে পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে।

প্রশ্ন জাগে এটাই কি নারী জীবন? বর্তমানে বাংলাদেশের মাননীয় স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ব্যাংক কর্মকর্তা, গবেষক, সৃজনশীল শিল্পী সর্বত্র নারীর ক্ষমতায়নের জয়জয়কার। তারপরেও নারীর অভিযোগ আছে নারী জীবন নিয়ে। নারী উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন চায় না। চায় স্বাধীন জীবন, একজন নারী একজন মানুষ এবং দ্বিতীয় লিঙ্গের অধিকারী বলে তাকে প্রথম লিঙ্গের সম্পদ বা সম্পত্তি হতে হবে এ ধারণাটাই ভাঙ্গতে চায় নারী দিবস।

নারীর অধিকারী বলে তাকে প্রথম লিঙ্গের সম্পদ বা সম্পত্তি হতে হবে এ ধারণাটাই ভাঙ্গতে চায় নারী দিবস। নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা, নিরাপত্তা, সুন্দর জীবন সর্বোপরি স্বাভাবিক মানব জীবনের প্রত্যাশায় নারী দিবসের দর্শন।

সমাজ প্রচলিত নারী জীবন নয় বরং নারী যখন তার নিজের মত করে নিজের জীবনকে পরিচালনা করতে পারবে তখনই তার জীবন প্রিয় হয়ে উঠবে তার কাছে। হতাশা আত্মহত্যা, দুর্বিষহ নারী জীবন নয়। সত্য, সুন্দর, মঙ্গলময় হয়ে উঠুক æপ্রিয় নারী জীবন”। জীবনকে প্রিয় জীবন হিসেবে উপভোগ করতে পারাই একজন নারী সবচেয়ে বড় সার্থকতা।

সায়মা রহমান তুলি : এম.ফিল গবেষক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকাটাইমস/০৮মার্চ/এসআর/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :