ডাকসুর দিকে তাকিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

প্রকাশ | ০৯ মার্চ ২০১৭, ০৮:১৮

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস

ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির জোর তাগাদা দেয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় সরকারি কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষ। তবে সবাই তাকিয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।

তাদের অনেকের ভাষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হলে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই ধারা চালু হয়ে যাবে।

৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচনের জন্য তাগাদা দেয়ার পর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার‌্য ও কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা হয় ঢাকাটাইমসের। কথা হয় কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গেও। তাদের বক্তব্যে উঠে আসে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের গুরুত্বের কথা।

নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় ছাত্রসংগঠনগুলো অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ আছে শিক্ষার্থী মহলে। এর পাশাপাশি দেশে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে বাধা।

যেমনটি বলছিলেন বরিশাল বি এম কলেজের অধ্যক্ষ এস এম এনামুল হাকিম। বুধবার মুঠোফোনে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত সত্য ও সময়োপযোগী কথা বলেছেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবশ্যই হওয়া উচিত। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি বি এম কলেজেও দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। তবে ডাকসু নির্বাচনের দিকেই সবার নজর। দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন হলে সেটিকে সবাই অনুসরণ করবে। আমরাও করব।’

১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পর ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এক নেতিবাচক ভূমিকা লক্ষ করা যায় দেশে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নেই। ফলে যখন যারা ক্ষমতায় গেছে, তার ছাত্রসংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে ছাত্ররাজনীতি। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হয় ছাত্ররাজনীতির প্রতি।

জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন অর রশিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে ছাত্রদের মধ্যে একধরনের ইতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ছাত্রসংগঠনগুলো কিছু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসে। ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে।’

আজকের জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত নেতাদের উদাহরণ দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘তাদের অধিকাংশই ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা। কিন্তু অনেক দিন ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভাবে নতুন প্রজন্মের ছাত্রনেতারা সুযোগ নেয় ছাত্রজীবন প্রলম্বিত করার। নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে একটা সময় ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার স্বীকৃতিও পেত।’

ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণ কী? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যতটা না প্রতিষ্ঠানের অপারগতা, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। এর মধ্যে যেমন আছে সরকার, তেমনি আছে রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উপাচার্য থাকাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একবার ছাত্র সংসদ-জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি ভোটের তারিখ ঘোষণার পর উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে আর হয়নি সে নির্বাচন।

ড. আনোয়ার হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যাতে জাকসু নির্বাচন হয়। কিন্তু আন্দোলন ও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়েই নির্বাচন স্থগিত করা হয়।’

তবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি সব মহলের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে পদক্ষেপ নেব। তবে ডাকসু নির্বাচন হলে আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠান সহজ হয়।’

বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে প্রতি বছর এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে তা অনুপস্থিত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন-উত্তর ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচন হয়ে এলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরো উল্টো চিত্র। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে নানা সময় আন্দোলন এমনকি আদালতের শরণাপন্ন হয়েও তার কোনো সুরাহা হয়নি।

তবে গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘ডাকসু ইলেকশন ইজ মাস্ট, তা না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে।’ রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের পর সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, ছাত্রসহ সবার মধ্যে ডাকসু নিয়ে প্রবল আগ্রহের জন্ম হয়েছে। রাষ্ট্রপতির তাগাদা কি পরিপালন হবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা সব সময়ই চেয়েছি ডাকসু নির্বাচন হোক। রাষ্ট্রপতি বলার পর এ বিষয়ে আরও জোর দেয়া হবে।’

৯০-এর পর প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এমন আশ্বাস দেয়া হয় সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি কোথাও।

দেশে মেয়েদের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজ কর্তৃপক্ষও চায় সেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। তবে ডাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে তাদের জন্য সহজে হবে বলে মনে করেন কলেজের উপাধ্যক্ষ ড. শামসুন নাহার। তিনি বলেন, ‘চারদিকে নির্বাচনী হাওয়া বইলে আমরাও নির্বাচন করতে পারব।’

জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক জিএস ও বিএনপির নেতা খায়রুল কবির খোকন বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটি জাতির নেতৃত্ব গঠনের অন্যতম সংঘ। এটা না থাকায় নতুন ও মেধাবী নেতৃত্ব তৈরি হয় না। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন খুবই জরুরি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি  মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত। কারণ এর মধ্য দিয়েই ছাত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। আর বন্ধ হয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এই নির্বাচনের পক্ষে। কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করা ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্যই আমরা নির্বাচন চাই। কিন্তু সব ছাত্রসংগঠনের সহযোগিতা না পাওয়ায় নির্বাচন করা যায়নি।’ ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্ররাজনীতিসহ জাতীয় রাজনীতির বিরাট ক্ষতি হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

আদালতে গিয়েও ফল আসেনি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচন চেয়ে ২০১৩ সালের ১২ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষার্থী। ৮ এপ্রিল প্রাথমিক শুনানি শেষে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চায় আদালত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থাই করতে পারেনি, যদিও উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পরই নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে তিন দফায় তফসিল ঘোষণা করলেও হয়নি নির্বাচন। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুনের পর একটি তদন্ত কমিটি ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার সুপারিশ করলেও সেই ৬ মাস আসেনি ২০ বছরেও।

(ঢাকাটাইমস/৯মার্চ/মোআ)