দাদা হও, দাদাগিরি করো না

অনুপম মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ১৫ মার্চ ২০১৭, ১৬:১২

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেলো। এর ফলাফল বেশ চমকপ্রদ। উত্তর প্রদেশ, উত্তরখন্ড, গোয়া ও মনিপুরে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ব্যবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংস্থা তথা আর এস এস এর রাজনৈতিক শাখা বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি)। বিশেষ করে মিনি ভারত নামে পরিচিত উত্তর প্রদেশে অখিলেশ যাদব-রাহুল গান্ধী জোটের পরাজিত হয়েছে। পাঞ্জাবে কোনমতে মান বাঁচিয়েছে সর্বভারতীয় কংগ্রেস।

২০১৯ সালে হতে যাচ্ছে ভারতের জাতীয় নির্বাচন। আবার বাংলাদেশেও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। নানা কারণেই বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারত একটা ফ্যাক্টর। সেটা নির্বাচনের সময়ই হোক বা রাজনৈতক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই হোক।

কিছুদিন আগেও নোট কাণ্ডে টালমাটাল ছিল ভারতের রাজনীতি। ঘোষণা দিয়ে হাজার টাকার নোট বাজেয়াপ্ত করে কালো টাকার মালিকদের রাতের ঘুম হারাম করে চমকে দেয় মোদী সরকার। এতে ভোগান্তি কম হয়নি, বিশেষ করে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া রোগীদের অবস্থা ছিলো শোচনীয়, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে এটা যে আপামর জনগণ পছন্দ করেছে এই নির্বাচনের ফলাফল তারই প্রমাণ। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে তরুণ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সাথে রাহুল গান্ধীর জোট যখন প্রত্যাশার বেলুনে হাওয়া দিচ্ছিল তখন এই ফলাফল ভীষণই হতাশার।

মনিপুরে ইরন শরমিলা চানু, যিনি গত ১৬ বছর অনশন করেছেন একটি কালো আইনের বিরুদ্ধে, তিনিও এই নির্বাচনে ভোট পেয়েছেন মোটে ৯০ টি। রণে ভংগ দিয়ে এখন তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে মনস্থির করেছেন। ২০২২ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি আর ২০২১ সালে আমাদের বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণ জয়ন্তী। সেই সময়টাতে কারা ক্ষমতায় থাকবে এটা এখন দুই দেশেরই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনেকটা প্রেস্টিজ ইস্যু...

ঠিকই এমনই সময় বাংলাদেশে ভারত নিয়ে বিবদমান দুটি রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খুব সরব। তিন দিক থেকে ভারত শুধু আমাদের ভূখন্ডকেই ঘিরে রাখেনি, ভারতীয় মিডিয়াও আমাদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরেই ভারতীয় চ্যানেলে ভরপুর। তাদের দেশের টিভি সিরিয়ালের নায়িকাদের পোশাক নিয়ে এই দেশে চরম বাড়াবাড়ি! এই পোশাকের জন্য অনেক কিশোরী-তরুণী আত্মাহুতি পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু আপনি জরিপ চালিয়ে দেখুন, এদেশের একটা বড় অংশ ভারতের ঘোরতর বিরোধী।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের উত্তরাঞ্চল ক্রমেই শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। পদ্মার বুকে চর জেগেছে। বরেন্দ্র এলাকায় জমিতে সেচের জল পেতে কষ্ট হচ্ছে। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা চুক্তি মোতাবেক পাচ্ছি কি না- এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা। এর উপর তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েও হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের অসহযোগিতায়। আবার ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বিহারে হচ্ছে অকাল বন্যা, ভাঙন। ফারাক্কায় বাঁধ বসেছিলো কলকাতার বন্দরকে সচল রাখার জন্য, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় ভোগান্তি বিহার রাজ্যবাসীর। ভারতের শাসন ব্যবস্থা যতোটা না কেন্দ্র নির্ভর তার চেয়ে বেশি রাজ্যনির্ভর। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্র কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আবার রাজ্যভিত্তিক দল ক্ষমতায় থাকায় কেন্দ্রের নিরঙ্কুশ আধিপত্য দেখাতে পারে না, আর তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় মোটামুটি একটা ভারসাম্য আছে। এখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী দাবি তুলছেন ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার জন্য।

নির্বাচন আসছে, জনরায় যার পক্ষে যাবে তিনিই বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে কিছু প্রচার-অপপ্রচার, যা কিনা নির্বাচনী কৌশল। বাংলাদেশে ভারত ইস্যু একটা শক্ত হাতিয়ার। বাংলাদেশের সীমান্তের বড় রাজ্য আসামে এই বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশি নাগরিকদের অত্যাধিক সুযোগ সুবিধার বিরোধিতা করে বিজেপি সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে।

নানা দিক থেকেই ভারত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙলে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ঢেউ লাগে। ভারতের পেঁয়াজে ঝাঁজ কম হলেও গৃহিণীদের পছন্দ কাটতে সুবিধে তাই। শাড়ি, কাপড়, জামা, জুতা এমনকি সর্বনাশা ফেনসিডিল, ভারত থেকে সবই আসে, শুধু পানিই আসে না...

ভারত থেকে গরু না এলে এদেশে কোরবানির হাট জমে না। তবে নির্বাচনের সময় ভারতকে গালি না দিলে বাক্সে ভোট পড়ে না । সেদিন দেখলাম আমাদের একটা টিভি চ্যানেল নরেন্দ্র মোদির পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের জয় উদযাপনের বক্তব্য লাইভ দেখাচ্ছে! কার্টুন নেটওয়ার্ক ও নাইক এদেশের বাচ্চাদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়, শুনেছি আমাদের ছেলেমেয়েরাও নাকি ভালো হিন্দি বলতে পারে। সেদিন দেখলাম একটি ছোট্ট মেয়ে তার ছোট ভাইকে নিয়ে খেলা করছে গলির রাস্তায়, ছোট ভাই পা পিছলে পড়ে যাওয়ায় বড় বোন জিজ্ঞাসা করছে ‘তুম ঠিক তো হো না...’ এর মানে বুঝতে একটু সময় লেগেছে আমার!

ভারতের নির্বাচনে জাত, পাত, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, রাজ্য, ভূপ্রকৃতি নানা সমীকরণ। বাংলাদেশে এখন জোট, মহাজোট, ঐক্য, মহাঐক্য নিয়ে সরগরম। বিশেষ একটি ধর্মের ভোট পরম আরাধ্য হয়ে উঠে। নির্বাচনের ফলাফল পক্ষ্যে বিপক্ষে যাই আসুক, আক্রান্ত হবেই এই সম্প্রদায়। এটা নিতান্তই আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যতা...

সংবিধানের বাইরেও বহুল প্রচলিত রাজনৈতিক শ্লোগান হচ্ছে ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। একমাত্র নির্বাচন এলেই এটি খুব বেশি কার্যকর বলে প্রতিয়মান হয়। রাজনৈতিক দলগুলো জনগনের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করে। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তথা ইশতেহার প্রকাশ করে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারে যারা ছিলেন কেউই স্বস্তিতে ছিলেন না। সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত জাতির পিতাকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালে। এর পর দীর্ঘ ৯ বছর দেশ শাসন করে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বিদায় নেয় স্বৈরাচারি এরশাদ।

১৯৯১ সালে বিএনপি, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০০১ সালে নিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চার দলীয় ঐক্যজোটের পর ১/১১ এর ঢেউ, তার পর ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট নির্বাচনে জিতে করে ক্ষমতায় আসে। অর্থাৎ টানা দুইবার কেউ ক্ষমতায় আসেননি। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো ২০১৪ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে থাকা জোট শুধু বর্জন করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তা প্রতিহত করার জন্য দেশব্যাপী ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। একটা নজিরবিহীন ভোটে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগেই ক্ষমতায় থাকাটা নিশ্চিত করে। এটা আইনগত ভাবে সিদ্ধ হলেও নৈতিকতার মনদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধই ছিল।

আসছে নির্বাচনে যে দল ক্ষমতায় আসবে তারাই উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, তবে তার চেয়েও বড় ইস্যু দেশের সার্বভৌমত্ব, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা। ইতিমধ্যে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময় প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই অপশক্তিকে মোকাবেলা করা। আমাদের অর্থনীতি এখন অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধ রপ্তানি আর বিশ্বব্যাপী জনশক্তির পাঠানো রেমিটেন্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে প্রয়োজন স্থিতিশীলতা। উন্নয়ন ও গনতন্ত্র একঙ্গে চলতে যেমন দল মত নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের একটা ঐক্য প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বন্ধু সুলভ সুপ্রতিবেশী।

কে কাকে মুচালেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এটা যেমন রাজনৌতিক কৌশল হতে পারে না, তেমনি সেটা হয়ে থাকলেও আমাদের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত একদিকে মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগর। আয়তন, পারমাণবিক শক্তি ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত বিশাল একটি দেশ। সেই দেশের বৈদেশিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রীয় নীতির প্রভাব পড়বেই বাংলার শ্যমল প্রান্তরে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয়, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সম্মুখ সমরে সম্মিলিত অংশগ্রহণ তরান্বিত করেছে আমাদের স্বাধীনতা। লাল সবুজের বাংলাদশের রক্তিম সূর্যে ভারতীয় যোদ্ধাদের রক্ত আমাদের ঋণী করেছে।

পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সমঝোতায় উপকৃত হবে দুই দেশ, তা না হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বেই। তাই প্রয়োজন বন্ধুত্ব, দাদাগিরি নয়...

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :