করমজলে একদিন

প্রকাশ | ১৮ মার্চ ২০১৭, ০৮:৫৫ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৭, ০৯:৫২

জহির রায়হান, সুন্দরবন থেকে ফিরে

‘করমজল’ নামটার মধ্যেই আছে একটি আকর্ষণ। আবার এর সঙ্গে যদি সুন্দরবন নাম জুড়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। যারা একদিনে সুন্দরবন ঘুরে আসতে চান তাদের জন্য ভালো উপায় হলো করমজলে যাওয়া। মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে পশুর নদী দিয়ে ট্রলারে ঘণ্টাখানেক লাগে করমজল যেতে। এই পয়েন্টে সুন্দরবন ঘুরে দেখার ব্যবস্থাপনা রেখেছে বন বিভাগ।

‘রাজস্ব যাত্রা’ শ্লোগান নিয়ে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি আয়োজন করে দুই দিনের যাত্রার। এর মধ্যে ছিল ২০১৭ ও ২০১৮ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনা ‘রাজস্ব সংলাপ’। বাগেরহাট ও গোপালগঞ্জে হয় এ রাজস্ব সংলাপ। এছাড়া ছিল বাগেরহাটের মংলা বন্দর ভবনের সভাকক্ষে ইআরএফেএর সঙ্গে মতবিনিময় ও বন্দর ঘুরে দেখার সুযোগ। প্রতি অনুষ্ঠানেই ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান।  

১৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় সেগুনবাগিচার রাজস্ব ভবনের সামনে থেকে ছাড়ে আমাদের বাস। সকালে পৌঁছে যাই খুলনা রয়্যাল মোড়ের হোটেল ‘ক্যাসেল সালামে’। সেখানে যার যার রুমে গিয়ে ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে ফ্রেস হয়ে সকালের নাস্তা সেরে রওয়ানা দিই সুন্দরবনের করমজলের উদ্দেশ্যে। মংলা ফেরি ঘাট এলাকা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিজস্ব বোটে চরে আমরা রওয়ানা দিই করমজলের উদ্দেশ্যে।

দীর্ঘযাত্রা পথের ধকল যেন করমজলেন যাত্রা প্রশান্তি এনে দেয়। বোট মংলা ফেরিঘাট এলাকা থেকে ছাড়ার পর মৃদু বাতাস গায়ে লাগতে থাকে। আমাদের বহরে ছিলেন ৬০ জন সাংবাদিক ও রাজস্ব কর্মকর্তারা।

বোটের ছাদে গিয়ে বসে নদীর দুই পাশের দৃশ্য ছিল সত্যিই মনোরম। নদীর পারে গোলপাতার ছাউনির ঘরে সোলার প্যানেল। ঘরের সামনে দিয়ে বই নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট শিশু।  নদীতে জেলেদের মাছ ধরা। দূরে দেখা যাচ্ছে মংলা সমুদ্রবন্দর। জাহাজগুলো চলছে সারি বেঁধে। ঢাকা ও খুলনা লেখা বড় বড় কার্গো চোখে পড়ল।

ঘণ্টাখানের মধ্যেই বোর্ট পৌঁছে গেল করমজলে। নামতেই চোখে পড়ল  সুন্দরবনের বড় একটি মানচিত্র যা কাঁচ দিয়ে ঢাকা। এখানে সুন্দরবন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়া আছে।

সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগ এখানে ‘ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র’ গড়ে তুলছে। রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বসেছে বিভিন্ন অস্থায়ী দোকান। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে সাহেবি ক্যাপ, বানর, কুমিরের আকৃতির খেলনা, বিভিন্ন ধরনের খাবার ও মধু। রাস্তা ধরে একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে বিশাল খোলা জায়গা খাঁচায় ঘেরা। যার ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো চিত্রা হরিণ। অনেকের হাত থেকে বাদাম খাচ্ছে হরিণ।

একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়লো কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। কোনোটিতে ছোট ছোট কুমির, কোনটা আবার মাঝারি। দেয়াল ঘেরা বড় পুকুরে দেখা গেল তিনটি বিশাল কুমির। কুমিরের ডিম দিয়েও কুমির প্রজনন করা হয়। কুমির তিনটির নাম রোমিও, জুলিয়েট ও পিলপিল বলে জানালেন নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা একজন। কুমিরের খাবারেরর জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুরগি। মুরগিগুলো দেয়ালের ভেতরে ছাড়া হলে কুমির কিভারে যেন টের পেয়ে গেল। পারে উঠে এলো কুমির তিনটি। মুখের ভেতরে মুরগি নিয়েই পানিতে নেমে গেল একটি কুমির। আরেকটি গেল ঝোপের ভেতরে। তিনটি কুমিরই মুরগি খেল। তবে এ নিয়ে কোনো কাড়াকাড়ি দেখা গেল না কুমিড় তিনটির মাঝে।

দেয়ালের বাইরে থেকে কেউ ভিডিও করছে কেউ আবার ছবি তুলছে। নিরাপত্তাকর্মীরা সাবধান করে দিচ্ছেন কেউ যেন ভেতরে হাত না দেয়। একবার লাফ দিয়ে প্রায় তিন হাত উঠে গিয়েছিল কুমির। এসময় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সবাই।

পুকুরের সামনে দিয়ে এগিয়ে যেতেই কাঠের তৈরি হাঁটার পথ। মাটি থেকে প্রায় চার হাত উপরে। পথটি এঁকেবেঁকে নিয়ে গেল বনের ভেতর। দুই পাশে সবুজের সমারোহ। দেখা মিললো বানরের। বনের ভেতরে এঁকেবেঁকে গিয়েছে খাল। খালের দুই ধারে ঘন গাছ। বেশিই বাইন গাছে। শাসমূলও চোখে পড়ল। বেশ একটু হাঁটলে ওয়াচ টাওয়ার সেখানে উঠে এক পলকে দেখে নিলাম সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্য।

আমরা তিনটার দিকে রওয়ানা দিলাম মংলার উদ্দেশে। এতো দ্রুত সময়টুকু কিভাবে কেটে গেল তা আমরা টেরই পেলাম না।

যারা এখনো সুন্দরবন যাননি তারা একবার ঘুরে আসতে পারেন। ঢাকার সায়দাবাদ বাস স্টেশন থেকে সরাসরি মংলা যায় বিভিন্ন বাস। মংলা ফেরি ঘাট এলাকা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যেতে পারেন করমজল। সারাদিন করমজল ঘুরে থাকতে পারেন মোংলায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল ‘পশুরে’। এছাড়াও মংলা শহরে কিছু হোটেল আছে।

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ আমাদের জাতীয় সম্পদ সুন্দরবন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এই সুন্দরবন। বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন  ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনে বাংলাদেশের মোট সংবক্ষিত বনাঞ্চল  ৫১শতাংশ।  বনে আছে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির রেপটাইল, ২৯১ প্রজাতির মাছ এবং ৩১৫ প্রজাতির পাখি।      

বন্যপ্রাণীর মধ্যে বাঘ ১০৬টি, হরিণ এক লাখ থেকে দেড় লাখ। বানর ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার। বন্য শূকর ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার। কুমির ১৫০ থেকে ২০০টি।

সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য ভ্রমণের স্থানগুলো হলো করমজর ইকোট্যুরিজম ও বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র (চাঁদপাই রেঞ্জ), হারবাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র (চাঁদপাই রেঞ্জ), কটকা ও কচিখালী ট্যুরিস্ট স্পট (খুলনা রেঞ্জ), কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র (সাতক্ষীরা রেঞ্জ)। নিজ দেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদ নিজ চোখে একবার দেখে আসতে পারেন আপনিও।

ভিডিও লিংক

(ঢাকাটাইমস/১৮মার্চ/জেআর/জেবি)