ক্রিকেট এখন আমাদের অস্তিত্ব, ঐক্যের প্রতীক

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৯ মার্চ ২০১৭, ২১:২২ | প্রকাশিত : ১৯ মার্চ ২০১৭, ২১:০৬

ক্রিকেট ছাড়া এত কাছে আর কোনো কিছুতে কখনো আসতে পারে বাংলাদেশ? এমনিতে এত দল, এত পথ, এত সর্বনাশা বিতর্ক! কিন্তু ক্রিকেটের বিজয় মানেই সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে হাতে হাত রেখে বিজয় উল্লাস। ক্রিকেটের বিজয় মানেই নানা সংকটকে দূরে ঠেলে আনন্দ অশ্রুতে ভেজে ওঠা চোখের কোনে চিকচিক করা এগিয়ে চলার অদম্য প্রত্যয়। এমনই এক মহিমান্বিত দিন হয়ে এলো ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল তার শততম টেস্ট ম্যাচ জিতে প্রতিটি বাংলাদেশিকে শুধু আনন্দ অনুভূতিতেই রোমাঞ্চিত করেনি, পুরো দেশকে দীর্ঘদিন পর বেঁধেছে ঐক্যের সুতোয়।

ক্রিকেট যেন বাংলাদেশকে নতুন করে চেনায় নতুন প্রজন্মের প্রতিটি তাজা প্রাণকে। সমস্ত গ্লানি, আত্মপরিচয়ের সংকট, জীবনের নানা অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটকে পেছনে ফেলে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কঠিন সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার রসদ যোগায় ক্রিকেটের প্রতিটি বিজয়। আমাদের ক্রিকেটাররা কি জানেন, তারা প্রতিনিয়ত এভাবেই বাংলাদেশকে বেঁধে চলেছেন এক বিরল মায়ার বন্ধনে। আমাদের এই টাইগাররা কি জানেন, এভাবেই তাদের প্রতিটি ছক্কা-চারে, প্রতিটি শারীরিক ভঙ্গিতে প্রতিটি বাংলাদেশির দেহ-মনে কী এক অনির্বচনীয় হিল্লোল সৃষ্টি করে চলেছেন।

রাজধানীর রাজপথে ধূলোমাখা ক্লান্তি-যাত্রায় ক্রিকেট কীভাবে যে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে হঠাৎ বৃষ্টির মতো বেহেশতি প্রশান্তির নহরধারা সৃষ্টি করে তা অবলোকন করতে এমন বিজয়ের দিনে খেটে খাওয়া মানুষের বদনে মনযোগী চোখ রাখলেই অনুভব করা যায়। মার্কেটগুলোতে টেলিভিশনের শোরুম গুলোর বাইরে উৎকণ্ঠিত, উল্লসিত মানুষের ভিড়। সে ভিড়ে নাই কে? স্কুল পালানো ছাত্র, কাঁচাবাজার হাতে গৃহকর্তা, রিকশা ফেলে ভিড়ে মিশে যাওয়া রিকশাওয়ালা, অফিস থেকে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়া বড় অফিসার। কে না জানে, পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীদের দলও নিজের 'কাজ' ভুলে মিশে গেছেন ক্রিকেটের উন্মাদনায়।

পাবলিক বাসে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া, ঘামে ভেজা কাপড়ে, গায়ে গা লাগিয়ে অনিশ্চিত জ্যামে আটকে দাঁড়িয়ে থাকা ত্যক্ত-বিরক্ত যাত্রীর দলও নিত্যদিনের কষ্ট ভুলে ব্যস্ত ছিল কী এক আনন্দ আলোচনায়। ক্রিকেট নগরের কষ্টময় জীবনে এভাবেই এনেছিল পরম প্রশান্তির এক বাতাবরণ।

পুরো দেশ, দেশ ও দেশের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকরা প্রতিটি বাংলাদেশিকে যেন হাজির করেছিল কলম্বোর সবুজ চত্বরে। খুলনার টাইগার মেহেদী মিরাজের ব্যাট থেকে যখন জয়সূচক রান আসল তখন জয়বাংলা বলে সবাই যেন ছুটে যেতে চাইছিল সিংহল সমুদ্র পার হয়ে কলম্বোর মাঠে।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে, বাজার, বন্দরে, অফিস-আদালত যেন থমকে ছিল খানিকের জন্য। মেহেদী-মুশফিকের বিজয় দৌড়ে শামিল হয়ে আবেগি বাংলাদেশিরাও সময় ভুলে রুদ্ধশ্বাস দৌড়ে কাঁপিয়েছে রাজপথ। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের হল-হোস্টেলে, শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পাড়া, দেশজুড়ে পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে ছেলে-বুড়োর দল ক্রিকেট ব্যাট, প্যাড, হাড়ি-পাতিল, ঢাক-ঢোল, কপালে-দেহে লাল-সবুজের পতাকা জড়িয়ে 'বাংলাদেশ' 'বাংলাদেশ', 'জয়বাংলা' স্লোগানে প্রকম্পিত করেছে বাংলার আকাশবাতাস।

ক্রিকেটের প্রতিটি বিজয় এদেশের মানুষকে কীভাবে, কতভাবে যে অনুরণিত করে তা ঠাহর করা সহজ কাজ নয়। বড়-ছোট, রিকশাওয়ালা-যাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নেতা-কর্মী, পিয়ন-সচিব, আমির-ফকির সবাই যেন এক নিমিষে এক কাতারে, একই ছায়াতলে মনপ্রাণ দিয়ে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় যে গৌরবের মহিমায়, সে যে ক্রিকেট।

আর কী এক শুভক্ষণেই না ক্রিকেট আবার প্রতিটি বাংলাদেশির মনে জাগাল দেশপ্রেমের চেতনা। মার্চ মাস। এ মাসেরই ১৭ তারিখ, ১৯২০ সালে জন্ম নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এ মাসেই সেদিন ৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', এ মাসেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেছিলেন। এমন একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ মাসে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের টাইগাররা পুরো জাতিকে, রাষ্ট্রকে ভাসালেন ঐক্যের সঙ্গীতে।

ক্রিকেট কী না করছে বাংলাদেশে? সীমান্তে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্রপ্রহরী বিজিবি সদস্য থেকে শুরু করে ঢাকার জনসমুদ্রে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ, কার মুখে না হাসি আনছে এই ক্রিকেট? হাসতে ভুলে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশভারি প্রফেসরও হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুশফিক-সাকিবের ছক্কা-চারে উল্লাসে ফেটে পড়ছেন একটু পরপর। আমাদের বাচ্চারা একটু পরপর বলে উঠছে 'জয় বাংলা'।

মাদ্রাসায় কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বাঙালি তরুণ-তরুণী, হিজাব-বোরখা পরা কিংবা প্যান্ট-শার্ট পরা তরুণী, হুজুর, পুরোহিত, কৃষক, সবজি বিক্রেতা, সেনা কর্মকর্তা, ফুটপাতের উপর ব্যবসা জমানো হকার কাউকেই বাদ দিচ্ছে না এই ক্রিকেট। সবাইকেই কাছে টেনে নিচ্ছে ক্রিকেট।

বাংলাদেশের জন্য ক্রিকেট শুধুমাত্র আর চার-ছক্কার খেলা নয়। শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের অস্তিত্বের আরেক নাম। ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের সেই সামিয়ানা, যেখানে দল-মত-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি বাংলাদেশি আশ্রয় নিচ্ছে পরম আনন্দে, নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে নতুন পরিচয়ে। ক্রিকেটই এখন নতুন প্রজন্মের প্রধান পরিচয়, ক্রিকেটই এখন ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের নিউক্লিয়াস।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :