হেফাজতের কাণ্ডকারখানা

প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০১৭, ১১:৫৩ | আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৭, ১২:১১

মাহবুব রেজা

সাম্প্রতিককালে হেফাজতে ইসলামের লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক অবস্থান ও গতি-প্রকৃতি সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। হেফাজতের অবস্থান যে তাদের আগের জায়গায় নেই সে বিষয়ে কারোর কোনো সন্দেহ নেই। এদের কর্মকাণ্ড ও দেউলিয়াপনা এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ একটা কৌতুকের জন্ম দিয়েছে।

হেফাজতের আমির আল্লামা শফি-পুত্রের সঙ্গে ক্ষমতা এবং পদ-পদবি নিয়ে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মতবিরোধ, বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের দরকষাকষি, লেনদেন, বাড়তি রোজগারের ধান্ধা ফিকির, আপসরফা- কোনো কোনো বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ‘শরিক দলের’ মতো সহাবস্থান হেফাজতকে প্রশ্নবিদ্ধ তো করেছেই। উপরন্তু তাদের অস্তিত্বকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা হেফাজতের অবস্থান ও সম্ভাব্য পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে বলছেন, সরকার তার অবস্থানকে নিরাপদ রাখতে হেফাজতকে ব্যবহার করার যে ফাঁদ বা নীতি গ্রহণ করেছে হেফাজত বহুমাত্রিকভাবে সেই ফাঁদে স্বেচ্ছায় পা বাড়িয়ে দিয়ে ধরা দিয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে হেফাজতের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা নয় সরকারই উল্টো তাদের ফাঁদে ধরা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা একে সরকারের এক ধরনের সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, বর্তমানে সরকারের নানা টোপে আবদ্ধ হতে হতে হেফাজতের রাজনীতির মধ্যে থেকে কার্যত রাজনীতিটাই ভ্যানিশ হয়ে গেছে। দলটি এখন সরকারের কাছ থেকে নানা উপায়ে ফায়দা লুটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। হেফাজতের রাজনীতি যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে দলের ভেতর শফি-পুত্র দ্বারা কোণঠাসা হয়ে থাকা নেতা-কর্মীদের আশংকাই সত্যে পরিণত হবে, হেফাজতের হেফাজত কে করবে?

হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জন্য উদ্বেগজনক ছিল এ কথা উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ দলটির প্রতি ধর্মীয় কারণে সাধারণ মানুষের আবেগ এবং সমর্থন দেখা গেলেও ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের ভয়াবহ তা-বলীলা প্রত্যক্ষ করে দেশবাসী শিউড়ে ওঠে। সেই ঘটনায় হেফাজতের আসল চেহারা দেশের মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। বিএনপি- জামায়াতের অসমাপ্ত কর্মসূচির বাস্তবায়নে হেফাজত যে শাপলা-নাটক সাজিয়েছিল তা দেশের মানুষসহ বহির্বিশ্বে পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও সে সময় সরকার তাদের কঠিনভাবে প্রতিহত করেছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মীয় রাজনীতিতে হেফাজতের বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততার কারণে শুরুতেই তারা রাজনীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে এবং এ ক্ষেত্র থেকে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। এসব কারণে হেফাজতের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আবেগ আর সমর্থন ছিল তা ম্লান হয়ে যায়। তবে শাপলা চত্বরে হেফাজতের এই নজরকাড়া বিশাল শোডাউনকে আমলে নেয় সরকার। বিশেষ করে হেফাজতের শক্তি- যে শক্তি আসলে বিএনপি-জামায়াতের যৌথ শক্তি, তাকে সমীহের চোখে দেখতে শুরু করে সরকার। আর হেফাজতও সরকারের এই দুর্বল অবস্থানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। আর তখন থেকেই সরকারের সঙ্গে শুরু হয় তাদের অলিখিত ‘হিসাব-নিকাশের’ হিসাব। হেফাজতের এই হিসাব-নিকাশকে বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সরকারের দেওয়া লোভ-লালসা আর প্রতিশ্রুতির কাছে হেফাজত যখন নানাভাবে ধরা দিতে থাকে তখন থেকেই হেফাজতের রাজনীতিতে পচনের শুরু হয়।

দুই.
বাংলাদেশে নাস্তিকতা, নারী নীতি ও শিক্ষা নীতিবিরোধী আন্দোলনের পর এবার হেফাজতে ইসলাম মাঠে নেমেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে। ভাস্কর্য অপসারণে যেকোনো মূল্যে সরকারকে বাধ্য করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছে তারা। তারা হুঙ্কার দিয়ে বলছে, সরকার এই ভাস্কর্য নিজে থেকে না সরিয়ে নিলে দেশে পুনরায় শাপলা চত্বর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে এবং এর দায়ভার সরকারকে বহন করতে হবে।

অতীতে হেফাজতের দেওয়া ১৩ দফা দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইসলাম অবমাননা কটূক্তিকারীদের মৃত্যুদ-ের আইন, দেশে ভাস্কর্য স্থাপন নিষিদ্ধ এবং শিক্ষানীতি বাতিল। দেশে ধর্মীয় কারণে হেফাজতের দাবি এবং এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ স্পর্শকাতর হওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদের সঙ্গে কিছু কিছু বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত ছাড় দিয়ে আপস করেছে যা জনমনে নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ।
স্পেস হবে

জানা যায়, বর্তমানে হেফাজতের ভেতরে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে চলছে টাগ অব ওয়ার। সংগঠনের আমির আল্লামা শফি-পুত্র আনাস চাইছেন পিতার শারীরিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দলের দায়দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে। এ ব্যাপারে তাকে দলের ভেতরকার একটি অংশ জোরালো সমর্থন দিচ্ছে। তারা চাইছেন আনাস দারুল উলুম মাদ্রাসার হর্তাকর্তা ও দলের আমির হলে তাকে দিয়ে আর্থিক সুবিধা ও বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বকে সাইজ করা যাবে। অন্যদিকে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীসহ শীর্ষ নেতৃত্ব এ ব্যাপারে ছাড় না দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন, হেফাজতের দায়িত্ব নিতে হলে তাকে দক্ষ ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বাবুনগরী জানিয়েছেন, আনাস দারুল উলুম মাদ্রাসার দায়িত্ব নিতে চান বলে শুনেছি, তবে হেফাজতের আমির হতে চান কি না তা আমার জানা নেই। অবশ্য তিনি চাইলেই এই সংগঠনের আমির হতে পারবেন না। কারণ সেই দক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা এখনো হয়নি তার।

হেফাজতের নীতিনির্ধারক মহল সূত্রে জানা গেছে, দলের বর্তমান নেতৃত্বের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে আমির-পুত্র আনাস। মতবিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে না গেলেও দু পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে যা সংগঠনটির জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না বরং হিতে বিপরীত হওয়ার শংকাও দেখছেন বলে সূত্রটি উল্লেখ করেছে।

হেফাজতে ইসলামের একাধিক সূত্র জানায়, পুত্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আল্লামা শফি রয়েছেন ঝুঁকির মুখে। দলের বিরাট একটি অংশের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকাকে সামনে রেখে তিনি আনাসের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বর্তমানে দায়িত্বে থাকা দলের সিনিয়র নেতাদের এড়িয়ে চলার নীতি মেনে চলছেন আমির। হেফাজতের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে আমির আল্লামা শফি এই অবস্থানে রয়েছেন বলে জানা গেছে। সূত্রগুলো আরও জানায়, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আপসরফা করে স্পর্শকাতর বিষয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার শর্তে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা এবং সরকারি বিশাল জমিজমা নিজের জিম্মায় নিয়েছেÑ এ রকম অভিযোগ রয়েছে আমীর-পুত্র আনাসের বিরুদ্ধে। এছাড়া দলের সূত্রগুলো আনাসের বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে আসা মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগও তুলেছেন।
হেফাজতের ঢাকা ও চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতারা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, মূলত শফি-পুত্র আনাস চাইছেন পিতা আর হেফাজতকে বিক্রি করে নিজের আখের গোছানোর। ক্ষমতাসীন দলের কাছে তিনি নানাভাবে হেফাজতকে স্বেচ্ছায় বিকিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছেন যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। আমিরের তহবিল থেকে হাতিয়ে নেওয়া হেফাজতের কোটি কোটি টাকা ও সন্দেহজনক সম্পদ সম্পর্কে সরকারি তদন্তের ভয়কে কৌশলে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের আমিরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেন না আনাস।

সর্বশেষ লালদীঘির ময়দানে রেসালাত সম্মেলনের শেষ দিন মঞ্চে আনাস-পুত্রের কল্যাণে হেফাজতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন মাওলানার উপস্থিতি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মূল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে আমির-পুত্রের এরকম ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো হেফাজতে ইসলাম কি দিন দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে?

হেফাজতের এই নিষ্ক্রিয়তার কথা স্বীকারও করেছে দলটির একাধিক নেতা। তারা জানান, এখন দেশে অস্ত্রতান্ত্রিক রাজনীতি চলছে। আমাদের কোনো অস্ত্র নেই। অস্ত্রের ভাষায় আমরা কথা বলতে পারি না। তবে ঈমান ও আকিদা রক্ষার প্রয়োজনে আমরা ফুঁসে উঠতে পারি তার প্রমাণ শাপলা চত্বরে রেখেছি।

তিন.
একদিকে হেফাজত নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য না সরালে সরকারকে শাপলা ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি হওয়ার হুমকিÑ এ রকম পরস্পরবিরোধী অবস্থান হেফাজতকে রাজনীতির অঙ্গন থেকে ক্রমেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে হেফাজতের রাজনীতি যদি এইভাবে চলতে থাকে তাহলে ক্ষমতাসীন দলের জন্য তা শুভফল বয়ে আনবে।

হেফাজতের নীতিনির্ধারণী মহলের একটি বড় অংশ বলছেন, হেফাজতকে রক্ষা করতে হলে এখনই সরকারের তাঁবেদারি বাদ দিয়ে তার আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে সরে এসে সঠিক নেতৃত্বের নিচে দলকে আনতে হবে। নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান মানুষের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। আর তা করতে ব্যর্থ হলে হেফাজতকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না।

মাহবুব রেজা: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক