একাত্তরে উত্তাল লন্ডন, ব্রিটিশ কাউন্সিলে বিরল চিত্র প্রদর্শনী

কাউসার চৌধুরী
| আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৭, ২১:৫১ | প্রকাশিত : ২১ মার্চ ২০১৭, ২১:৪৮

খবরটি উজ্জ্বল দাশের কাছেই পেয়েছি প্রথম। উজ্জ্বল দাশ প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১-এর উদ্যোক্তা ও সমন্বয়কারী। আসলে- 'খবর' নয়, বলা যায় নিমন্ত্রণ। আমার ফেসবুক ইনবক্সে ছোট্ট একটি নিমন্ত্রণ- ‘বৃটিশ কাউন্সিল-এ একাত্তর ভিত্তিক একটি চিত্র প্রদর্শনী চলছে। সময় পেলে ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে’।

আমিও আর আগপাছ না ভেবে দৌড় দেই বৃটিশ কাউন্সিলে। দীর্ঘদিন বৃটিশ কাউন্সিলে যাওয়া হয়না! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে এর সদস্য ছিলাম। এরপরে বার দু’এক ‘আংরেজী’ শিখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু মিশন ফেল! আগে যা জানতাম- সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম নতুন আংরেজীর ধাক্কায় ! যাই হোক, ভরদুপুরে ফুলার রোডের বৃটিশ কাউন্সিলে গিয়ে হাজির হই।

নানারকম নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাশ করার পরে ভেতরে ঢুকে যাই। বৃটিশ কাউন্সিল পাল্টে গেছে একেবারে আগাপাশতলা! এই মিলনায়তনে বহুবার নাটক করেছি। অংশ নিয়েছি বহু কর্মশালায়। নিজেও ‘মাষ্টারি’ করেছি কমুনিকেশনস আর মিডিয়া নিয়ে। ফটোগ্রাফি নিয়েও কসরত দেখিয়েছি কয়েকবার! কিন্তু এবারে গিয়ে বৃটিশ কাউন্সিলের বহিরাঙ্গ দেখে দৃষ্টি স্থির হয়ে রইলো অনেকক্ষণ !

সেই চেনা বৃটিশ কাউন্সিলের সবুজ মাঠটি বদলে গেছে বড়ো বড়ো ফটোগ্রাফ, দরোজা, ছোট ছোট স্ট্যান্ড আর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা দিয়ে। এক লহমায় চলে গেলাম একাত্তরে! একাত্তর পূর্ববর্তী লন্ডনকে মনে হল আমার চিরচেনা! অথচ স্বাধীনতার পূর্বে বিদেশে যাওয়া তো দূরের কথা কোনদিন ঢাকায়ও আসিনি। বাহাত্তরের মার্চ মাসে আমি প্রথম ঢাকা ‘সফর’ করি চট্টগ্রাম থেকে!

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা-চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের মুখেই প্রথম ‘ইষ্ট পাকিস্তান হাউজ’ (পূর্ব বাংলার ছাত্রদের একটি হোষ্টেল), ‘ইষ্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’- এসবের নাম শুনেছিলাম আশি সালে। আলমগীর কবিরও পঞ্চাশের দশকে লন্ডনেই পড়াশোনা এবং সাংবাদিকতা করেছেন। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জেনেছি, সেই সময়ে তিনি কিউবা’য় গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে। এসব কথা আমি যথেষ্ট প্রামাণ্যতা এবং বিশ্বস্থতার সাথে বস্তুনিষ্টভাবে আমার প্রামাণ্যচিত্র 'প্রতিকূলের যাত্রী’তে সংযোজন করেছি।

আলমগীর কবিরের মৃত্যুর পরে আমি তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘প্রতিকূলের যাত্রী’ (Counter Image), যা এখন YouTube-এ পাওয়া যায়। সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সামান্য গবেষণা করতে গিয়ে ‘ইষ্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ এবং বিলেতে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মকান্ড নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারি।

অবশ্য আলমগীর কবির তাঁর ডায়রীতেও ‘একাত্তরের লন্ডন’ নিয়ে অনেক কথা লিখে গিয়েছেন। যদিও একাত্তরে আলমগীর কবির ছিলেন ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন হাতে যুদ্ধের মাঠে। সেই সময়ে তিনি ‘আহমেদ চৌধুরী’ ছদ্মনামে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবর পাঠ করতেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজী বিভাগের প্রধান (যদি ভুল না জানি)।

নাট্যজন আলী যাকের সেই সময়ে সরাসরি আলমগীর কবিরের অধীনে war reporter-এর কাজ করতেন এবং তিনিও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর পড়তেন। বলছিলাম একাত্তরের লন্ডনের কথা। জ্বী হ্যাঁ, আমিও মনে করি স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে এবং মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতে বসবাসকারী বাঙালিদের একটি বড়ো ভূমিকা আছে। অবশ্য তখন তো আর আজকের মত বাঙালিরা সারা দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো না! তখন বিদেশ মানেই ছিল- ‘বিলেত’! বিলাতে যেতে পারা তখন অনেক বড়ো ব্যাপার!

সেই ‘বড়ো ব্যাপারের’ মানুষগুলো কিন্তু আমাদের সংগ্রামে-সংকটে টাই-স্যুট কিংবা গাউন পরে ঘরে 'বিলেতি চুলার' পাশে বসে থাকেননি! নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। উজ্জ্বল দাশ বলেন-

“দূর পরবাসে থেকেও বহু মুক্তিকামী বাঙালি এবং অবাঙালি নাগরিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাঁপিয়েছেন বিলাতের রাজপথ! প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদী দিনমালা থেকে- লন্ডন হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন- পুরো সময়কাল নিয়ে ‘লন্ডন ১৯৭১’ শিরোনামের আলোকচিত্র ও ঐতিহাসিক স্মারক প্রদর্শনীর আয়োজন”।

তিনি বলেন- ‘বাঙালিদের পাশাপাশি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিশ্ব জনমত গঠনে বৃটিশ এমপি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরাও রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। যেমন, ৫ মার্চ ১৯৭১-এ লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেন বাঙালিরা। ৩ এপ্রিল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে স্মারকলিপি দেন মহিলা সমিতির নেতারা। ২৬ জুলাই ১৯৭১-এ হাউজ অব কমনস-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাক টিকেট ও উদ্বোধনী খাম প্রদর্শন করা হয়। ১ আগষ্ট ১৯৭১ স্বধীন বাংলাদেশের সমর্থনে একশন বাংলাদেশের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় কালজয়ী বিশাল সমাবেশ। ২৭ আগষ্ট লন্ডনে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন স্থাপন।

৮ জানুয়ারি ১৯৭২-এর ভোরে হিথরো বিমান বন্দরে অবতরণ করেন স্বধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সন্ধ্যায় ক্লারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধুর জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন।

বিলেতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনমত গঠন ও ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ তহবিল সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা পালন করে স্টিয়ারিং কমিটি অব একশন কমিটিজ, সকল আঞ্চলিক একশন কমিটি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, মহিলা সমিতি ইউকে, বাংলাদেশ মহিলা মেডিক্যাল এসোসিয়েশন ইন ইউকে, একশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগা’।

উজ্জ্বল দাশ বিলেতে দীর্ঘ ৭ বছর গবেষণা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন- নিজের উদ্যোগে নিজের খরচে। এই সময়ে তিনি বৃটিশ আলোকচিত্রী রজার গোয়েনের সন্ধান লাভ করেন। যাঁর তোলা দূর্লভ অনেক আলোকচিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালের অনেক অদেখা মুহুর্তের সাক্ষী। এছবি ছবি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনের পর প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছে।

উল্লেখ্য, লন্ডনের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নাগরিক ইউসুফ চৌধুরীর তোলা কিছু ছবিও উজ্জ্বল দাশ সংগ্রহ করেছেন। পাশাপাশি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলা ও ইংরেজী সংবাদপত্রের কাটিং, পোষ্টার, প্রচারপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে গত বছর আগষ্ট মাসের ১৮ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় ‘প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর প্রথম প্রদর্শনী করেন। সেই সময়ে এই চিত্রগুলো দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা অর্জন করে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ বৃটিশ কাউন্সিল-এ এই প্রদর্শনীর আয়োজন।

বর্তমানে অবশ্য এই একই কর্মটি সিলেট এবং চট্টগ্রামেও প্রদর্শনের আয়োজন চলছে। উজ্জ্বল দাশের মত সৎ এবং উদ্যমী মানুষেরা আছেন বলেই আমরা এখনো কিছু ‘সৎকর্ম’ দেখার সুযোগ পেয়ে থাকি। একটি কথা বলে রাখতে চাই- তা হল এই প্রদর্শনীর ‘পরিবেশন স্টাইল’। এই প্রদর্শনীর (স্থাপনা বলাটাই যথার্থ) ডিজাইন করেছেন একজন শিল্পী শেহজাদ চৌধুরী। উনি সম্ভবত নিউ ইয়র্ক-এ থাকেন। ঢাকার বৃটিশ কাউন্সিলের পেছেনে মিলনায়তনে প্রবেশ-মুখের মাঠ এবং বর্তমান ক্যাফে’র সামনের সবুজ লন’টি ঘিরে করেছেন এই স্থাপনা!

ক্যাফের সামনের ল’নে ৮টি কালো অনুচ্চ পিলার দিয়ে একটি ভিন্ন স্বাদের উপস্থাপনার অবতারণা করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আটজন গার্ড এই বৃটিশ কাউন্সিলে কর্তব্যরত ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী এই আটজনের প্রত্যেককেই গুলি করে হত্যা করে সে রাতে। সেই আট জনের স্মরণে কালো পাথরের এই স্থাপনাটির কাছে গেলেই শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে শিল্পী যথাসময়ে এই কাজটি করেছেন নিপুনভাবে। এরপাশেই রয়েছে আমার মনের মত কিছু লেখা- Boycott Pakistan, Boycott Pakistani Goods, Recognise Bangladesh, Stop Genocide-সহ আরো অনেক প্লাকার্ড!

মিলনায়তনের প্রবেশমুখের মাঠ’টিতে সাজিয়েছেন বিশাল সাইজের ছবির পাশাপাশি একেবারে ১০X১২ সাইজের ছবিও। এরপাশেই রয়েছে একাত্তরের বিভিন্ন দলিল। বড়ো সাইজের ছবিগুলোর পাশে ছোট সাইজের দলিলগুলো এমন সব চমৎকার ফ্রেমে ঝুলিয়ে প্রদর্শন করেছেন- না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন!

আমি সবচেয়ে অভিভূত হয়েছি ছবিগুলোর কাছে যাবার জন্য কিছু ‘দরজার’ ব্যবহার। আশেপাশে কোন দেয়াল নেই, ওপরে ছাঁদ নেই, কিন্তু ‘দরজা’ দিয়ে প্রবেশ করছি প্রতিটি ছবির প্রাঙ্গণে! এক একটি দরজাকে মনে হয় যেন মহাকালের এক একটি সুড়ঙ-মুখ! যে মুখ দিয়ে আমি চলে যাবো বর্তমান time & space-কে অতিক্রম করে কোন এক মহাকালে! আর অনেকগুলো ছবি টানানো হয়েছে এরকম ফ্রেমের শিকলে ঝুলিয়ে।

কোন কোন ছবি আবার স্থান পেয়েছে- সবুজ কোন বৃক্ষের নিচে। ওখানেও তৈরী হয়েছে ভিন্ন ‘কোন’, ভিন্ন মাত্রা। ছবির একটি ‘চাকতি’ বিশাল একটি 'দাঁড়ানো ছবি'র (vertical) পাশে শুয়ে আছে। ফর্ম এবং 'কোনে'র এমন জ্যামিতিক ব্যবহার আজকাল খুব কমই চোখে পড়ে।

শিল্পী শেহজাদ চৌধুরীকে অভিবাদন। অভিবাদন উদ্যোক্তা গবেষক উজ্জ্বল দাশ’কে।

বৃটিশ কাউন্সিল’কে একটি উষ্ণ ধন্যবাদ না দিলে বোধকরি পাপ হবে। তাদের আঙ্গিনায় এমন অসাধারণ একটি স্থাপনা পরিবেশন করতে সহযোগিতা করায় বৃটিশ কাউন্সিল আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হল। ঢাকার বৃটিশ কাউন্সিলে এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত।

প্রদর্শনীটি না দেখলে বড়ো একটা কিছু সম্ভবত ‘মিস’ হয়ে যাবে!

স্বাধীনতার মাসে, সরকার যেখানে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষনা করেছে, সেই মাসে গণহত্যা বিরোধী এমন আয়োজন’কে সাধুবাদ জানাই। জয় হোক বাঙালির। জয় বাংলা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরঞ্জীব হোন।

লেখকঃ নাট্যাভিনেতা, নির্মাতা ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :