বদরুলের শাস্তির তাৎপর্য

সৈয়দ শিশির
 | প্রকাশিত : ২২ মার্চ ২০১৭, ১১:৪১

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা নারীর পক্ষে একটি দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়েছেন। বিচারক খাদিজা আক্তার নার্গিস হত্যাচেষ্টার রায়ে ৩২৬ ধারায় বদরুল আলমের যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।

কলেজছাত্রী খাদিজা হত্যাচেষ্টার রায়ে বদরুলের যথোপযুক্ত শাস্তি নারীদের সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা। দেশের সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে বিচারকের এ মন্তব্যের সঙ্গে আমিও সম্পূর্ণরূপে একমত।

বিচার বিভাগকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, তারা নারী দিবসে একটি কঠিন রূঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন : ‘তারা প্রতি পদে পদে নিগৃহীত, নির্যাতিত, হত্যা ও যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছেন। এর জন্য আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতা দায়ী।’

নারীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা ঘটছে, সেখানে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একজন খাদিজার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ার রায় পাওয়ার সত্যিই একটা তাৎপর্য রয়েছে। বিশেষ করে এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যখন বিচারকের রায়ে বাংলাদেশে নারীর অবস্থানের একটা বিবরণ বিস্তারিত জায়গা করে নিতে পেরেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সূত্রে জানা যায়, সিলেট জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘সিলেটের এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে ৩২৬ ধারায় আসামির যাবজ্জীবন বিরল।’ এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে কেউ নারীদের ক্ষমতায়নে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, নারীর ওপর এ ধরনের নৃশংস আচরণ না হয় সেজন্য এ রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ এক্ষেত্রে বলতে হয়, প্রতিটি নৃশংস আচরণের যেন এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

যতদূর জানা গেছে, বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নারী। সর্বস্তরে যখন নারীরা সাফল্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে তারা এখনো অরক্ষিত, নির্যাতিত।’ সত্যিই এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত। কারণ এ দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিক্ষা, চিকিৎসা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আইন পেশা, ব্যবসা ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন।

গার্মেন্ট সেক্টরে নারীদের অবদান দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করে দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করছে। শুধু কি তাই? এ দেশের দুই নারী হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেছেন। দেশের কৃষিতে এবং নির্মাণকাজেও নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও আনন্দের বিষয়- এ দেশের নারীরা এখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

এ দেশের নারীরা ক্ষমতায়নে এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জনে ও শিক্ষায় বিশ্বে রোল মডেল। এ দেশের নারীরা আজ আর নারীশিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কথিত অন্দরমহলের অবরোধবাসিনী নন। তাহলে এ দেশের নারীরা অরক্ষিত থাকবেন কেন?

বিচারক আকবর মৃধা তার রায়ে উল্লেখ করেছেন, ‘নারীদের সুরক্ষার জন্য পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, যৌতুক নিরোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ইত্যাদি দেশে বলবৎ আছে।’ কিন্তু অপ্রিয় হলেও বলতে হচ্ছে, সেখানে উল্লেখ নেইÑ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত দেশের ৭২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। খাদিজার সিলেট বিভাগের চার জেলায় বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি নারী নির্যাতনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তার মানে দাঁড়ায়, নারীরা প্রকৃতঅর্থে আজও দ্রুত বিচার থেকে বঞ্চিত।

অবশ্য কাগজে-কলমে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ ১৯৭৯-এর বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করি।

উল্লেখ্য, গত বছর ৩ অক্টোবর সিলেটের এমসি কলেজ কেন্দ্রে স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক (পাস কোর্স) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা। বদরুল আলমের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খাদিজার মাথার খুলি ভেদে করে মস্তিষ্ক জখম হয়। খাদিজার সুস্থ হতে সাড়ে চার মাসের বেশি সময় লাগে। আর পাঁচ মাস পাঁচ দিনে বদরুলের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে ৮ মার্চ রায় দেন বিচারক।

সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে সংঘটিত নৃশংসতায় খাদিজা আক্তার নার্গিসকে যখন কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়, তখন খাদিজা ‘মাগো, মাগো’ করে চিৎকার করছিল। কিন্তু তাকে কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। আসলে সমাজের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মাত্রাটা অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

মানুষ কতটা হিংস্র হলে এমন নারকীয় কা-ের জন্ম দিতে পারে তা ভেবে অবাক, মর্মাহত হতে হয়। এসব ঘটনায় আরও মর্মাহত হতে হয় যখন দেশের একটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর দ্বারা এমন জঘন্য কর্মকা- ঘটে! অবাক হতে হয় যখন শুনি বদরুল আলম এমসি কলেজের সবুজ চত্বরে, পুকুর পারে ফিল্মি স্টাইলে খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছিল, তখন পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ ভিডিও করছিল। এগিয়ে আসার সাহস হয়নি কারো! কেউ আসেনি তা নয়; তবে আরো আগে আসার প্রয়োজন ছিল। তাহলে খাদিজা আঘাত পেতো কম। অবশ্য দেরিতে হলেও যারা এগিয়ে এসেছিলেন, তারা মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন।

আসলে এ ঘটনার দায়ভার আমাদের প্রত্যেকের ওপরই বর্তায়! কেননা বদরুল আমাদের আশপাশেরই একজন। বদরুল কিন্তু এ সমাজে একক কোনো চরিত্র নয়! আরো বহু বদরুল ঘাপটি মেরে আছে এ সমাজে। তাই আমাদের সতর্ক হতে হবে আর কোনো খাদিজাকে যেন ‘মাগো, মাগো’ করে আর্তনাদ না করতে হয়।

অনেকের মনে আশঙ্কা ছিল বদরুলের বিচার হবে তো! কারণ আসামি বদরুল ছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। প্রেম প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নিয়েছে সে পরিকল্পিতভাবে। মৃত ভেবে ফেলে রেখে পালানোর সময় সে জনতার হাতে আটক হওয়ার পর পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। ভিডিওতে স্পষ্ট যে, বদরুল কি নৃশংসভাবে কুপিয়েছে নার্গিসকে। তাকে ঢাকায় আনার পর চিকিৎসকরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। তখন তারা শুধু একটি কথাই বলেছেন, নার্গিসের মাথা আর হাতে অসংখ্য গভীর ক্ষত। অবশ্য মেয়েটি বেঁচে গেছে আল্লাহ্র অশেষ রহমতে এবং বাংলাদেশি ডাক্তারদের চিকিৎসায়। বলতে হয়, খাদিজার চিকিৎসা কোনো এলেবেলে ইস্যু ছিল না। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন তারা বিশ্বমানের।

রায়ে খাদিজার প্রতি বদরুলের প্রেমের দাবি প্রসঙ্গে বিচারক যথার্থ বলেন, ‘মানব-মানবীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা চিরন্তন। অন্যথায় পৃথিবীর পথচলা থেমে যেত। প্রেম-ভালোবাসায় মিলন-বিরহ থাকবেই। প্রেম-বিরহে বা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে এহেন পৈশাচিক, নৃশংস আচরণ মোটেই কাম্য ও আইনসমর্থিত নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভিকটিম খাদিজা অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তি নারী।

প্রেমে প্রত্যাখ্যাত পাষ- প্রেমিকের চাপাতির নৃশংস আঘাতে ক্ষতবিক্ষত খাদিজা দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে না যাওয়া সারা বিশ্ব নারী সমাজের প্রতিভূ, বিজয়িনী, প্রতিবাদকারিণী। আমার বিশ্বাস, আসামির ওপর সর্বোচ্চ শাস্তি আরোপের মাধ্যমে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হাজার হাজার বদরুল (তথাকথিত রোমিও বা উত্ত্যক্তকারীরা) ভবিষ্যতে এহেন কা- থেকে বিরত থাকবে এবং আমাদের নারী সমাজ সুরক্ষিত হবে।’

বিচারকের এ বিশ্বাস যেন সত্য হয়¬ সেই লক্ষ্যে দেশবাসীকে একযোগে কাজ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, দণ্ডবিধির যে ধারায় বদরুল যাবজ্জীবন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, সেই ধারার আওতায় তাকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়ত সম্ভব ছিল। কিন্তু তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়াটা বিচারক যথাযথ মনে করেছেন। দেশবাসীও তাতে সন্তুষ্ট। অবশ্য বদরুল রায়-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দাবি করেছেন যে, তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। কিন্তু আমি মনে করি, বিশ্ব নারী দিবসের রায়ে শাশ্বত প্রেমের প্রতি বদরুলের পৈশাচিক অবমাননার প্রতিকার মিলেছে।

বিভিন্ন সময়ে খাদিজার মা বলেছেন, বদরুল নাকি তাদের বাড়িতে লজিংয়ে ছিল, দুধ- কলা খাইয়েছেন, সে এমন কাজ করবে ভাবেননি। আসলে কি, দিন বদলে গেছে, আগের দিন আর নেই, নেই সেই মানুষ। খাদিজার পরিবারের মতো এই রকম আরো অনেক পরিবারের মানুষ ছিল উদার, মেধাবী শিক্ষিত একটি ছেলেকে বাড়িতে থাকার সুযোগ করে দিতেন নিঃস্বার্থভাবে। কিন্তু প্রতিদান এমন কেউ আসা করেননি। তাই এখন থেকে ভাবতে হবে! প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা থেকে আমাদের নতুন করে শিক্ষা নিতে হবে।

তর্কের খাতিরে বলতে হয়, খাদিজা কি সত্যিই বদরুলের সঙ্গে প্রেম করেছিল? ধরে নিলাম করেছিল এবং ৬ বছর পর সে আর থাকতে চায়নি সেই সম্পর্কে। কিন্তু এটা কেন এত বড় অপরাধ হবে? যেকোনো কারণেই তো সম্পর্ক ভাঙতে পারে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের যেসব দোষ-ত্রুটি থাকে, খাদিজারও তাই থাকবে।

এটা কি খাদিজার খুব বড় অন্যায় ছিল? না, অবশ্যই না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সমাজে প্রতারণার শিকার হলে পুরুষ নারীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা, শারীরিকভাবে মারধর করা এবং তারপর কুপিয়ে মারার মানসিকতায় চলে যায় কেন? সবশেষে বলছি, দেশের আর কোনো নারী যেন এ রকম হামলার শিকার না হয়।

সৈয়দ শিশির : কবি, সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :