ছোটগল্প

অদ্ভূতুড়ে

ড. সাহানা বেগম
 | প্রকাশিত : ২৩ মার্চ ২০১৭, ১৪:০০

সে ছিল ঘন ঘোর বর্ষার সময়। সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে ঝর-ঝর, ঝর ঝর। 'কাঁপে পাতা পত্তর'। কয়েক মূহুর্তের জন্য যদি বা কমল তাও তা পড়তে থাকল টিপ টিপ, টিপ টিপ। আকাশ তার সুরমা কালো মেঘের পর্দাখানি নিয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি নেমে এসেছে, একেবারে কাছে।

এত বৃষ্টি কদিন ধরে একটানা, সাথে দমকা বাতাস আর বিজলির খেলা চলছে যে প্রাত্যহিক কাজকর্ম গোল্লায় যেতে বসেছে। আমাদের এবং আর সবার স্কুল থেকে ছুটি ঘোষণা করেছে। স্কুল বন্ধ কি মজা! পড়া নেই কি মজা! কিন্তু সে আর কদিন। প্রথম কদিন ঘরের ভেতরে খেলাধূলো বেশ লাগল। স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা রহস্য বইগুলো পড়লাম কাঁথামুড়ি দিয়ে। ঘন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, সূর্য বিহীন মৃদু আলো, ক্ষণে ক্ষণে কড় কড়াৎ বাজের আওয়াজ এমন দিনেই তো রহস্য গল্প জমে ভাল।

এক সময় বই গুলোও শেষ হলো, খেলনাগুলো নিয়ে খেলাও শেষ হলো, কিন্তু বৃষ্টির ঝম ঝমিয়ে পানি পড়ার যেন কোন শেষ নেই। আমাদের বাড়ীটি কাঠের তৈরী, লোকে বলে জাহাজ-বাড়ী। উঁচু উঁচু, মোটা মোটা কাঠের পায়ার উপর ঘরখানি বসানো। পায়ার আশে পাশে তলাটা ফাঁকা। কুকুর, বিড়ালের দিনের বেলা, অনেক সময় রাতের বেলাতেও নিরুপদ্রপ ঘুমানোর জায়গা।

তিনখানি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, দরজা পেরিয়ে তবে নীচ তলায় ঢোকা যায়। নীচ তলার মেঝেয় কাঠের পাটাতন দেওয়া।নীচ তলায় মা রাঁধা-বাড়া করেন। আমাদের খাওয়া দাওয়া, পড়াশোনা সবই নীচ তলায়। পাটি পেতে, কখনও বা মোছা মেঝে খানির উপর বালিশ নিয়ে দিনের বেলা আমরা ঘুমুই। ছোট শহর, বাড়ী ঘর এমনিতেই অনেক ফাঁকা ফাঁকা। দোতলা তিনতলা বাড়ীঘর কিছু দেখা যায় বটে তবে বেশীর ভাগই টিনের একচালা দোচালা আর আছে আরও কিছু বেড়ার দেয়ালের ছোটছোট বাড়ীঘর। সারা শহর খুঁজলে এমন জাহাজ বাড়ী একটি কি দুটি দেখতে পাওয়া যায়। আমার পিতা কি ভাবে যে এমন অদ্ভূত সুন্দর একটি বাড়ীর সন্ধান পেলেন!

খুব গর্বের ব্যাপার আমার জন্যে, বন্ধু- বান্ধবরা মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভূত বাড়ীটি দেখতে আসে। তাদের সবার চোখে একটা ঈর্ষা খেলা করে বেশ বুঝতে পারি। তখন মনে মনে বাবার এই বিশেষ বাড়ীটি পছন্দ করাকে তারিফ করি। আমার বেশ অহংকার হয়, নিজেকে কেউ কেটা একজন ভাবতে ভাল লাগে।

আমার ছোট আর একটি ভাই ও বোন আছে। ভাইটি তো যেন পথ ভোলা এক দেবদূত, ভুল করে আমাদের ছোট্ট কাঠের বাড়ীটায় আশ্রয় নিয়েছে। কি মায়াময় মধুমাখা তার কথাবার্তা,আর কি চমৎকার মন কাড়া নিষ্পাপ হাসি। নীলাভ সাদায় তিমির কালো পুতলীর, জল টলটলে সদা-অবাক দুটি চোখ। আমাকে ডাকে 'দাম্মা' বলে। ওর 'দাম্মা' ডাকে আমি হই দিশেহারা।

কিন্তু আজ কি হল? আমি অবাক হচ্ছি ওর আচরণে। খানিক আগে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল, "দাম্মা, আমার ফাই ইন্জি, আমার ফাই ইন্জি। এনে দাও,এনে দাও।"

ওর জন্যে আমি প্রাণ পাত করতে পারি এমনই ভালবাসি আমি ওকে। বোনটাকেও কি আমি কম ভালবাসি! আমি যেন ভালবাসতে আর ভালবাসা পেতেই জন্মেছি। ভালবাসায় ভরপুর এক স্বর্গ আমাদের এই জাহাজ বাড়ী। কত সকালে ঘুম ভেংগে দোতলার মেঝের লম্বা ফাটা দিয়ে বাবা-মাকে পরস্পরের হাতে হাত নিয়ে চা খেতে দেখেছি। অথবা দেখেছি নির্ণিমেষে পরস্পরের দিকে অপলক চেয়ে থাকতে।

আমার ছোট ছ'মাস বয়সের বোনটি আমায় দেখলেই অবোধ্য ভাষায় 'তাতা', 'তাতি' নানান শব্দ করে দুহাত তোলে কোলে ওঠার জন্যে। কোলে উঠে ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আরামে আহলাদে বিগলিত কুঁ কুঁ আওয়াজ করে। কিন্তু আজ কি হলো। পৃথিবী হঠাৎ এত এমন বদলে গেল কেন?

ফাই ইন্জি অর্থাৎ ফায়ার ইনজিন নামে খেলনাটির রহস্য উদঘাটনে ব্যাপৃত হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে তোমার ফায়ার ইন্জিনের? পড়ে গেছে নদীতে। নদীতে? অর্থাৎ পানিতে; অঝোর ধারার বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে।দমকা বাতাস থেমেছে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সবিরাম। আমাদের জাহাজ বাড়ীর নীচের তলাটা দেড় মানুষ সমান উঁচু পানিতে ডুবে গেছে।

একতলার ভিতর দিয়ে দোতলায় ওঠার যে সিঁড়িটা সেটা প্রায় তলিয়ে গেছে। বাবা সেদিন অফিস গেলেন নৌকায় করে। দুদিন তিনি আসেন না তাঁর খবরের কাগজের অফিস থেকে; তিনি আসবেন না দু রাত, খুব নাকি কাজ পড়েছে। আশ্বাস দিয়ে গেছেন আগামী কাল বিকেলের মধ্যেই নাকি বৃষ্টি থেমে যাবে আর পানি নাকি দ্রুত নেমে যাবে।

বাবা এসব কি বলেন, আমি দেখছি আকাশ মাটির তৈরী পোড়া হাঁড়ির তলার মত ঝুলে আছে পৃথিবীর উপর! কি জানি হবেও বা। বাবা যে পত্রিকা অফিসে কাজ করেন, তারা যে আগাম সব কিছু জানতে পারে। মায়ের ভারী ভরষা বাবার উপর।

আমি ঝাঁপিয়ে পানিতে পড়লাম। কিন্তু খেলনা কই? পানি যে আমার মাথার উপর দিয়ে বইছে। ভাগ্যিস সাঁতার জানি।আনাচে কানাচে কোথাযও নেই। প্রথমে মনে হয়েছিলো বড় জাম্বুরা গাছের গুঁড়ির সাথে আটকে ওটা হয়ত বা ভাসছে।না তা তো নয়। ভাইটার হাসিমুখ দেখতে চেয়েছিলাম, বীরত্ব দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু না এবার উঠে পড়তে হবে।এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

পানির একটা জোরালো টান অনুভব করছি খালের দিকে। এবার উঠব। সাঁতরে দোতলার বারান্দার কাছাকাছি গিয়ে উপরে রেলিং ধরে এক হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠতে চাইলাম। বাদ সাধল ছোট ভাই।

কতৃত্বের সুরে সে বলল "খুঁজে নিয়ে এস ফাই ইন্জি, এখনই উঠছ কেন?”

চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। এভাবে তো কখনও কথা বলে না। লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো জ্বলছে অংগারের মত। চেহারা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর, যদিও ওর আগেকার চেহারার আদলটুকু আছে। আমি আবারও উঠতে চেষ্টা করলাম। এবার আমার ভাই কোথা থেকে একটা লোহার রড এনে আমার আঁকড়ে ধরা হাতের আংগুলে আঘাত করল। প্রচন্ড যন্ত্রণায় হাত ছেড়ে দিয়ে আমি একটু তফাতে সরে আসি। এমন সময় মা এলেন ঝুল বারান্দায়। আমি তাঁকে সমস্যাটা জানালাম। মা একটা ক্রুর নিষ্ঠুর হাসি হেসে বললেন, "খেলনাটা নিয়ে তবেই উঠবি।"

মা আমি যে আর সাঁতরাতে পারছিনা। মা বলেন "খেলনা নিয়ে তবেই উঠবি, আগে নয়।"

মা ঘরের ভিতর চলে গেলেন।ভাবলাম এতদিন কোন ভালবাসার ছলনায় তাহলে ভুলেছিলাম। আমি যাদের এত ভালবাসি এরা তাহলে কারা? এরা কি তবে দূরাত্না, প্রেতাত্না। আর একবার রেলিংটা ধরে উঠতে চেষ্টা করলাম। নিমেষের ভিতর কোথা থেকে আমার অত প্রিয় ভাই একটা জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ নিয়ে এসে আমার আংগুলে চেপে ধরল।

উঃ, মাগো বলে চীৎকার করে উঠে ডুবে যেতে থাকলাম। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। একটু বাতাস আহ্ মাগো একটু বাতাস। খুব জোরে টেনে শ্বাস নিতে চাইলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখুনি আমি মারা যাব..

..... এই তো শ্বাস নিতে পারছি। আমার চোখের দৃষ্টি আমার ঘরের ছাদে। বিছানায ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে আমি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্ন দেখছিলাম পঞ্চাশ দশকের পটভূমিকায়। আমাদের কোন জাহাজ বাড়ীও ছিল না আর আমি দুই ভাইয়ের পর সর্বকণিষ্ঠ বোন। স্বপ্ন কত অদ্ভূতুড়ে হয়। আপনারা কি বলেন?

লেখক পরিচিতি

গল্পকার ড. সাহানা বেগম জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট, গাজীপুরে কর্মরত ছিলেন। তিনি মূলত পতঙ্গবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ফিলিপাইনের সেন্ট্রাল লুজন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি এমএস করেছেন। ড. সাহানা বেগম ২০০৪ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন।

ঢাকাটাইমস/২৩মার্চ/এসবি/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :