গোঁফজোড়া কামিয়ে ঢাকা ছাড়েন কর্নেল ওসমানী!
সাতই মার্চের ভাষণ্যের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। জাতির জনক ভেতরে ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন। কৌশলগত কারণেই তার সব সহচরকে বিষয়টি বুঝতে দেননি।
তাই বঙ্গবন্ধু যে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, ঘনিষ্ঠ অনেকেই তা আগেভাগে জানতে পারেনি। এমনকি ২৫ মার্চ রাতে যারা তার সঙ্গে দেখা করেছেন, পরিস্থিতি সম্পর্কে আলাপ করেছেন তাদের অনেকেই বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সেই সন্ধ্যায়, সেই রাতে যারাই এসেছেন তাদের সবাইকে নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করতে বলেছেন। পাকি বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে বলেছেন। অনেকের অনুনয়-বিনয়ের পরে বঙ্গবন্ধু কিন্তু নিজে পালিয়ে যাননি। এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন। এখানেও কিন্তু অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রখর রণকৌশলের প্রমাণ মেলে।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার মতো নেতার পালিয়ে বেড়ানোর সুযোগ খুব কম। পাকিস্তানি বাহিনী এই সুযোগে তাকে মেরে ফেলতে পারে। তাই বাসায় থেকে ২৫ মার্চের কালরাতে মানে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার সবকিছু শেষ করেন বঙ্গবন্ধু। তারপর জাতির জনককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ বিষয়টি তিনি মার্চের গোড়ায় অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই ঐতিহাসিক সাতই মার্চ তিনি বলেছিলেন-
‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু - আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ যে সমাগত সে বিষয়টি কিন্তু আঁচ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ বিষয়ে ১৯৭২ সালে মনজুর আহমদকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কর্নেল (পরে জেনারেল) মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানী বলেছেন- ‘যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’- বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণের অন্তরালে ছিল একটি সুচিন্তিত রণকৌশল। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈনিকদের কাছে ছিল বিরাট তাৎপর্যময়। বস্তুত এই আহ্বানকে তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার ইঙ্গিত বলেই মনে করেন।’’
২৫ মার্চের কালরাতে কর্নেল ওসমানী কোথায় ছিলেন? কী করছিলেন তিনি? এ বিষয়ে মনজুর আহমদ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পরও জেনারেল ওসমানী সে রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। কোথা থেকে যেন হঠাৎ করে ছুটে এসেছিলেন। কিছু আলাপ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তার পরই আবার দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন নেতৃত্বস্থানীয় সর্বশেষ ব্যক্তি, যিনি সবার পরে এ বাড়ি ছেড়েছিলেন। কিন্তু তারপর? হায়েনাদের শ্যেনদৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন তিনি? এত পরিচিত চেহারা নিয়ে কেমন করেই বা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো ঢাকা থেকে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া?
ঢাকা থেকে বেরোতে পারলেও পালানোর পুরো রাস্তাটি খুব একটা নির্বিঘœ হয়নি তাঁর জন্য।
এই কাহিনিই মনজুর আহমদকে বলেছিলেন বঙ্গবীর ওসমানী। সেই সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওসমানী জানিয়েছিলেন, হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিখ্যাত গোঁফ জোড়াটি কামিয়ে ফেলেছিলেন। ঢাকা থেকে তিনি পালিয়েছিলেন ২৯ মার্চ। ২৫ মার্চ রাত থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন নিউ ইস্কাটনের একটি ফাঁকা বাড়িতে।
এই বাড়িতে বসেই সেই কদিন তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেছেন সামনের রাস্তায় হানাদার সৈন্যদের উন্মত্ততা। দেখেছেন গাড়ি বোঝাই সৈন্যদের ক্ষিপ্ত আনাগোনা।
একদিন খানসেনারা খ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজে ফিরেছে জেনারেল ওসমানীকে। তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে চালিয়েছিল হামলা। প্রতিটি ঘরেই ঢুকেছে দরজা ভেঙে। ফাঁকা ঘরগুলোতেই তারা চালিয়েছে মেশিনগানের গুলি। অথচ ওরা ভাবতেও পারেনি, ওদেরই নাকের ডগায় নিউ ইস্কাটনে বসেই তাদের এই একান্ত প্রার্থিত ব্যক্তিটি তাদের দুষ্কর্ম সচক্ষে দেখছেন। এই কদিনে নিউ ইস্কাটনের অপরাপর কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালালেও হানাদারেরা সম্ভবত ফাঁকা বাড়ি ভেবেই জেনারেল ওসমানীর আশ্রয়স্থান ওই বাড়িতে হানা দেয়নি।
এই প্রসঙ্গে জেনারেল ওসমানী মনজুরকে বলেছিলেন, পরম করুণাময়ের অশেষ অনুগ্রহ ছিল তাঁর ওপর। তা না হলে এমনভাবে কজন রক্ষা পায়!
২৯ মার্চ তিনি এ বাড়ি ছেড়ে বের হন। বেরোনোর আগে তিনি তাঁর আদল পাল্টে ফেলেন। আর এই চেহারা বদলানোর জন্য প্রথমেই তাঁকে কামিয়ে ফেলতে হয় তাঁর বিখ্যাত গোঁফ জোড়া।
গোঁফ কামিয়ে ফেলে হানাদারদের হাত থেকে বাঁচলেও তাঁকে কিন্তু পড়তে হয়েছিল আরেক বিপদে। ঢাকা থেকে বেরিয়ে জিঞ্জিরা পৌছেই তিনি নদীপথে রওনা হয়ে যান দাউদকান্দি। এখানে তিনি পড়েন সংগ্রামী বাঙালি তরুণদের কবলে। তারা তাঁকে পশ্চিমা ভেবে আটক করে ফেলে। এ সময় তার পক্ষে নিজের সঠিক পরিচয় দেওয়াও ছিল বিপজ্জনক। কিছু সময় পরেই এসে পড়েন ওই এলাকার নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যের এক ভাই। তাঁর পরিচয় পেয়ে জেনারেল ওসমানী তাঁকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে নিজের পরিচয় দেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে এই ভদ্রলোকই তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
[তথ্যসূত্র : মনজুর আহমদের একটি লেখা ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের ঢাকা ত্রৈমাসিক পত্রিকার ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যায় ‘২৫ মার্চ রাতে কেমন করে পালিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানীর সাক্ষাৎকার নেন। যা ছাপা হয়েছিল দৈনিক বাংলায়।]