জঙ্গি আতঙ্কের এক রাত

ইফতেখার রায়হান
 | প্রকাশিত : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১৯:০১

শুক্রবার মানেই ছুটির দিন। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে কোনো ছুটির দিনই ছুটির নয়। তারপরও কেন জানি শুক্রবার এলেই আমার মধ্যে ছুটি ছুটি মনে হয়। গতকাল শুক্রবারও (২৪ মার্চ) তেমনি টঙ্গীতে সহকর্মীদের নিয়ে কফি হাউজে চা চক্রে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সন্ধ্যার পর হঠাৎ অফিসের ফোন থেকে কল এলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঢাকাটাইমসের যুগ্ম সম্পাদক ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ ভাই বললেন দ্রুত বিমানবন্দর চেকপোস্টে চলে যান। সেখানে আবারও আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে।

দেরি না করে ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যেতে যেতে মাথায় একটাই দুশ্চিন্তা, রাস্তায় যানজট থাকলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। বিমানবন্দর এলাকার পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন দিয়ে ঘটনার ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম। বিমানবন্দর গোলচত্বরের তল্লাশি চৌকির সামনে আসতেই নাকে বিস্ফোরিত বোমার বারুদের গন্ধ ভেসে আসতে লাগলো। র‌্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। আত্মঘাতী হামলাকারীর লাশটি লাল-কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীরাও এতক্ষণে ঘটনাস্থলে চলে এসেছেন।

টিভি চ্যানেলের সহকর্মীরা লাইভে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। লাশের ছবি তুলতে একটু সামনে যেতেই একজনকে বলতে শুনলাম বিস্ফোরণে হামলাকারীর পেটের অংশ নাকি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কথাটা শুনেই গত শুক্রবার (১৭ মার্চ) আশকোনার হাজিক্যাম্প সংলগ্ন র‌্যাবের নির্মাণাধীন অস্থায়ী ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলাকারীর লাশের ছবিটি চোখে ভেসে উঠল। কী বীভৎস সেই ছবি, প্রথম দেখায় যে কেউ শিউরে উঠবেন।

এবার মূল ঘটনায় আসি। ঘটনাস্থলে থাকা পরিচিত এক সহকর্মী সাংবাদিকের কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম হামলাকারীর ছবি। নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে বেশ কয়েকবার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। পরে বাহির থেকে বেশ কিছু ছবি তুলে অফিসে পাঠাই। এর কিছুক্ষণ পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপির বোম ডিস্পোজাল ইউনিটের প্রধান সানোয়ার হোসেন, ডিসি (উত্তর) বিধান ত্রিপুরাসহ র‌্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বাইরে গণমাধ্যমর্কীরা অপেক্ষা করছেন কখন ব্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনার বিস্তারিত জানানো হবে। কিন্তু আশকোনার ঘটনার মতো এবারও মিডিয়ার সামনে কথা বলেননি র‌্যাব মহাপরিচালক। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দ্রুত বের হয়ে যান তিনি। এর কিছুক্ষণ পর রাত সাড়ে ৯টায় সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া। তল্লাশি চৌকিতে বিস্ফোরণের ঘটনা কোনো আত্মঘাতী হামলা নয় বলে জানিয়ে আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এতে জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

সাংবাদিকদের ব্রিফিং শেষে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন ডিএমপি কমিশনারও। ডিএমপি কমিশনার জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য বললেও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে সেটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় বোম ডিসপোজাল ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণের কাজ। বোম ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান সানোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, নিহত যুবকের কাছে যে ব্যাগটি পাওয়া গেছে সেখানে বেশকিছু তাজা বিস্ফোরক রয়েছে। এগুলো এখানেই নিষ্ক্রিয় করা হবে।

রাত সাড়ে দশটায় র‌্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীসহ জনসাধারণকে ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বাড়ানো হয় বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা। বোম ডিস্পোজাল টিমের কার্যক্রম দেখেই আঁচ করতে পেরেছিলাম বোম নিষ্ক্রিয়করণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এর কিছুক্ষণ পরেই রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে বিকট শব্দে প্রথম বোমাটি নিষ্ক্রিয় করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১১টা ৩৮ মিনিটে দ্বিতীয় ও ১২টা ২২ মিনিটে তৃতীয় বোমাটি নিষ্ক্রিয় করা হয়। তবে দ্বিতীয় বোমাটি ছিল সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের বিকট শব্দে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকা কেঁপে উঠে। আশপাশের বেশকিছু ভবনের জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ট্রাফিক পুলিশের বক্সটিও। এসময় বোমার স্প্রিন্টারের আঘাতে ও পুলিশ বক্সের পাশের মসজিদের জানালার কাচ ভেঙে আহত হন পাঁচজন। আহতদের মধ্যে একজন পুলিশ কনস্টেবলও আছেন বলে জানা গেছে। তাদেরকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ফয়সাল (৩৫), মিল্লাত (২২) ও জাকির (২০) এর পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা স্থানীয় খাবার হোটেলের কর্মচারী। বাকি দুজনের নাম পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। তিনটি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হলেও ওই ট্রলি ব্যাগটিতে আরও বিস্ফোরক রয়েছে কি না সে বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের আগে বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশের সবধরনের যানচলাচল সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দে গাড়িতে বসা যাত্রীদের ও আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

নেত্রকোনাগামী বাসে চড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন আব্দুর রহমান। বোমা নিষ্ক্রিয় করার বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে তিনি বাস থেকে নেমে দৌড়ে রাস্তার পাশের একটি গাছের তলায় আশ্রয় নেন। এসময় আব্দুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলাম। বিমানবন্দরের পুলিশ বক্সে আত্মঘাতী হামলার কথা জানতাম না। ভেবেছিলাম সিগন্যালে গাড়ি আটকে আছে। পরে বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরণের শব্দে ভয়ে বাস থেকে নেমে পড়ি। ঢাকাটাইমস প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে আব্দুর রহমানের চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ বোঝা যাচ্ছিল। এমন আতঙ্কের ছাপ বোঝা যাচ্ছিল বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও।

কথা হয় ঘটনাস্থলে থাকা বিমানবন্দর হকার্স লীগ সভাপতি সাগর মিয়ার সাথে। বিস্ফোরণের ঘটনা বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেন। সাগর বলেন, ‘সন্ধ্যার পর আমি চায়ের দোকানে দাঁড়াইয়া চা খাইতেছিলাম। এইহানে সবসময়ই পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশরা থাকেন, চা খান। নিরাপত্তা নিয়ে আমাগো কোনো সময়ই দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দে আমার কইলজাটা কাইপ্পা উঠে। বারুদের গন্ধ নাকে আসতেই গিয়া দেখি পুলিশ বক্সের সামনে একটা লোক মইরা পইরা আছে।’ এভাবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই।

আশকোনার র‌্যাবের ব্যারাকে হামলার পর দেশের সব বিমানবন্দর এবং কারাগারে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। জোরদার করা হয়েছিল নিরাপত্তাব্যবস্থা। এর সাত দিনের মাথায় মাত্র কয়েকশ গজ দূরে পুলিশ বক্সের সামনে ফের বিস্ফোরণ ঘটায় বিমানবন্দর এলাকার জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। সবার চোখে মুখেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্কের ছাপ। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের বিকট শব্দে গণমাধ্যম কর্মীরাও মাঝে মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিলেন। সন্ধ্যা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত বিমানবন্দর এলাকার লোকজন ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছিল এ আতঙ্ক। এই হামলার পর ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস হামলার দায় স্বীকার করে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য দেশে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তারা সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার জন্য নব্য জেএমবি নামের একটি সংগঠনকে দায়ী করছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলাগুলো দেখার পর মনের ভেতর একটা শঙ্কাই বারবার উঁকি দিচ্ছে ‘এই বুঝি আমার প্রাণের স্বাধীন বাংলাদেশটা ইরাক-সিরিয়া হয়ে যাচ্ছে!’

লেখক: সাংবাদিক, ঢাকাটাইমস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :