সেই ছবির তিন কিশোর যোদ্ধার সন্ধান

রেজাউল করিম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৬ মার্চ ২০১৭, ০৭:৪৭ | প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০১৭, ০৭:৩০

প্রায় সমবয়সী তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ছবি। তাদের একজন লক্ষ্যবস্তুতে গ্রেনেড ছুড়ছে। পাশে দুজন একই লক্ষ্যবস্তুর দিকে বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়ছে। এটি কেবলই একটি ছবি নয়। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মারক হয়ে উঠেছে ছবিটি।

এই তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামে। ছবিতে যে কিশোরকে গ্রেনেড ছুড়তে দেখা যাচ্ছে, তার নাম আব্দুল খালেক। মাঝে রাইফেল হাতে আব্দুল মজিদ। বাঁয়ে মজিবর রহমান।

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গোধূলিলগ্নে ময়মনসিংহের সম্ভুগঞ্জে পাকসেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটির বাংকার ধ্বংসের চিত্রটি ফ্রেমে আটকান মানিকগঞ্জের নাইব উদ্দিন নামের একজন ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই তিন বীরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ছবিটি প্রকাশের পর স্বজনরা জানতে পারে তারা বেঁচে আছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে এই তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ছবিটি অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধিকাংশ প্ল্যা-কার্ড, ফেসটুন, ব্যানারসহ পাঠ্যবইয়ের গল্পের প্রচ্ছদেও ছবিটি ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু যে ছবি আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রজন্মান্তরে ঘুরছে, তাঁদের খোঁজ কজন জানে? এই তিন বীরের পরিচয় ও দুঃসাহসিকতা অনেকেরই অজানা।

ঢাকাটাইমসের অনুসন্ধানে মিলেছে দুর্লভ এই ছবির দুরন্ত তিন যোদ্ধার পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধে অবদান আর তাদের সামাজিক অবস্থান।

সেই কিশোরদের একজন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মুশুরিয়া গ্রামের মৃত হযরত আলী ও রূপজানের ছেলে। মজিবর রহমান ওই গ্রামের মৃত মনসের আলী ও মৃত সখিনা বেগমের সন্তান। আব্দুল মজিদও একই গ্রামের মৃত সলিম উদ্দিন ও সোনাবানুর সন্তান। মজিবর রহমানকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে রিকশা চালাতে হয়েছে। আরেকজন কখনো কারখানার শ্রমিক কখনো বা নৌকার মাঝি হয়ে জীবিকার সংস্থান করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে তাদের ভাগ্যে জোটেনি বাড়তি কোনো সম্মাননা। তিনজনের মধ্যে দুজনই দীর্ঘ সময়ে পাননি সম্মানজনক কোনো উপার্জনের উৎস।

তাদের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ছিলেন সবচেয়ে বেশি আলোচিত। তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকাটাইমসের। কথায় কথায় বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন বাজি রেখে লড়াই আর দুঃসাহসিক অভিযানের। জানালেন নানা আক্ষেপও।

ওরা চিরবীর

খালেক, মজিদ ও মজিবর প্রায় সমবয়সী। তখন ১৩-১৪ বছরের কিশোর ওরা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা প্রেরণা পান। ২৫ মার্চের কালরাতের ঘটনায় তারা বুঝতে পারেন যুদ্ধ সন্নিকটে। ২৬ মার্চ থেকে সংকল্প নেন দেশকে বাঁচাতে সংঘবদ্ধ হতে হবে। প্রথমে তাদের মনে হয়েছিল বাঙালি সৈনিকরাই পারবেন দেশকে মুক্ত করতে। অনিশ্চয়তা দেখে সমবয়সীদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন তারা। মে মাসের শেষের দিকে তারা ২১ জন বন্ধু মিলে নৌকাযোগে ভারতের মাইনকার চরে চলে যান।

তিন দিন পর তাদের মেডিকেল হয়। তুরা ক্যাম্পে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেখানে আলফা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ২১ দিন ফ্রন্টফাইটার এবং সাত দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৭০০ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা দেশে ফেরেন। তাদের কৌশল ছিল, ‘হিট অ্যান্ড রান’। সুযোগ বুঝে শত্রুসেনার ওপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যাওয়া।

কিছুদিন পর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী (ইন্ডিয়ান আর্মি ৬ বিহার) রেজিমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামেন। তারা শুধু পাক সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণই নয়, ধ্বংস করেন তাদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি। তারই একটি প্রতিচ্ছবি আলোচিত ছবিটি।

তাদের আক্ষেপ সাদা মনের মানুষ আব্দুল খালেক। দেশপ্রেম হৃদয়জুড়ে। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে প্রচার পেতে তার প্রবল আত্মস্লাঘা। সংসার যে সচ্ছল নয়, এরই সাক্ষী যেন ভাঙা বাড়ি।

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের লম্বা তালিকা দেখে বিস্ময় ও আর হাতাশা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, তখন যদি সত্যি এত মুক্তিযোদ্ধা থাকত, তাহলে দেশ শত্রুমুক্ত হতে ইন্ডিয়া-রাশিয়ার সাহায্যের প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে দেশ যেমন স্বাধীন হতো না, তেমনি টাঙ্গাইল না থাকলে এত মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যেত না।’

অথচ দুর্লভ ছবির সেই তিন মুক্তিযোদ্ধাদের এখনো কোনো উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। তাদের নিয়ে নেই বিশেষ কোনো উদ্যোগ। রাস্তায় টাঙানো তার নিজের ছবি দেখতে গিয়ে অনেক সময় খটকা লাগে। সাদাসিধে পোশাকে তিনিই যে ছবির মানুষটি তা অন্যকে বোঝাতে বেগ পেতে হয়। তবে এবারের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে ওই বিশেষ ছবিটি ব্যবহার করেছে উপজেলা প্রশাসন। সঙ্গে তিনজনের পরিচিতি।

ওই বিখ্যাত ছবিটি নিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের কাছে খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর গেটে তৈরি হচ্ছে একটি ভাস্কর্য। এমন আর একটি ভাস্কর্য তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার নিজ উপজেলায় নির্মাণের দাবি জনগণের। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় আড়াই শ কবিতা লিখেছেন আব্দুল খালেক। অর্থের অভাবে সেগুলো আর প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। তার বাড়িতে রয়েছে ছোট্ট একটি ভাঙা ঘর। সেখানে সযত্নে রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় নিদর্শন। সরকার ঘরটি একদিন আঞ্চলিক জাদুঘরে রূপান্তর করবে এই প্রত্যাশা তার।

আবদুর খালেক গোগ্রীন অটবি লিমিটেডের গুলশান শাখার অ্যাম্বাসেডর পদে চাকরি করতেন। অটবির ব্যবসায়িক অবস্থা মন্দা থাকায় বেতন বকেয়া পড়ে। চাকরি ছেড়ে অবসর কাটাচ্ছেন চট্টগ্রামের ফয়’স লেকে। তার চার ছেলে-মেয়ে। ছেলেরা পৃথক সংসার পেতেছে। সরকারি ভাতাই এখন তার একমাত্র উপার্জন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন সম্মাননা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

মজিবর রহমান ২০১৪ সালে মারা যান। মজিবর রহমানের স্ত্রী সাহাতন বেগম ঢাকাটাইমসকে জানান, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মজিবর। তার চার ছেলে। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবিকার জন্য রিকশা চালাতে হয়েছে তাকে। তার ছোট ছেলে রনি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে। সাহাতন বেগমের স্বপ্ন, সরকার রনির কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।

অপরজন আব্দুল মজিদ। তিনি ব্যাটালিয়ান আনসার-এ প্লাটুন কমান্ডার পদে কাপ্তাইয়ে কর্মরত আছেন। মুঠোফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। তার তিন মেয়ে। ওই সময়ে অর্থের অভাবে কাউকে উচ্চ শিক্ষিত করতে পারেননি তিনি।

এটা কি শুধুই ছবি

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মারক হয়ে ওঠা ছবিটি নিয়ে দেলদুয়ারবাসীর গর্ব কম নয়। তারা মনে করে, এটি কি কেবলই ছবি? ছবিটিতে প্রকাশ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ বীরত্বের কথা। তাই ছবির মানুষগুলোকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করা উচিত। তাদের প্রত্যাশা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশেষ ছবির একটি ভাস্কর্য নির্মাণ হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিশেষ জায়গায় নাম উঠবে দেলদুয়ার উপজেলার।

আলোচিত এই ছবির একজন আব্দুল খালেককে চেনেন দেলদুয়ার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের বাবলু। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আব্দুল খালেককে চিনি। ছবির অপর দুজনের কথাও শুনেছি।’ তিনি উপজেলায় ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানান।

দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদত হোসেন কবির ঢাকাটাইমসকে জানান, দুর্লভ ছবির তিনজন বীরকে পরিচিত করতে এবারের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রের প্রচ্ছদে তাদের ওই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে তাদের পরিচিতি। ভাস্কর্যের বিষয়ে তিনি বলেন, জেলা পরিষদের সহযোগিতা পেলে একটি ভাস্কর্য তৈরি করা সম্ভব।

(ঢাকাটাইমস/২৬মার্চ/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :