মূল্যায়িত হওয়ায় খুশি মাগুরার বীরাঙ্গনা লাইলি
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আর সরকারের দেয়া পাকা বাড়ি পাওয়ায় দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে জমে থাকা বুকের ভেতরের চাপা ব্যথা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে যুদ্ধ সাহসিকা (বীরাঙ্গনা) মাগুরার লাইলি বেগমের। স্বাধীনতার জন্য তাঁর চরম ত্যাগের বিনিময়ে দেশের মাটি শত্রুমুক্ত হলেও বছরের পর বছর অবহেলা আর অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের বাবা-মা পর্যন্ত কোনোদিন খবর নেয়নি। তবে বর্তমান সরকার তাঁর ত্যাগের মূল্যায়ন করায় তিনি আনন্দিত। দেশের স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ এখন তিনি গর্ব অনুভব করেন। আগের তুলনায় অনেকটাই স্বাচ্ছন্দে জীবন কাটে লাইলির। তবে স্থানীয় দালাল রাজাকারদের বিচার এখনও না হওয়ায় তার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
লাইল বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদারদের পৈশাচিক নির্য়াতন আমাকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছে, দেশ স্বাধীন হবার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে প্রায় ৪৫ বছরের অপেক্ষা এর থেকে কম ব্যথা দেয়নি। স্থানীয় দালাল, রাজাকার, মানবতাবিরোধীরা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের বিচার হচ্ছে না, যা মনের মধ্যে ব্যথা দেয়।’
ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খানিকটা সুখানুভূতি প্রকাশ করেন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী লাইলি বেগম। দেশ এবং জাতির জন্য তার যে চরম ত্যাগ তা অনেক দেরিতে হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়িত হয়েছে এতে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারানোর ব্যথা অনেকাংশেই দূর হয়েছে বলে জানালেন তিনি। রাষ্ট্র শুধু যে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিসহ ১০ হাজার টাকা ভাতা দিয়ে তার দারিদ্র-পীড়িত জীবনকে অনেকটা স্বচ্ছল করে দিয়েছে তাই নয়, বর্তমান সরকারের ’বীর নিবাস’ প্রকল্পের আওতায় তাকে একটি পাকা বাড়ি তৈরি করে দিয়ে মাথা গোজার ঠাঁই করে দিয়েছে। যা তার জীবনের কষ্ট অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছে।
মাগুরা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ আট লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি পাকা ল্যাট্রিনসহ তিন কক্ষ বিশিষ্ট লাল সবুজের বাড়িটি ইতিমধ্যেই তার কাছে হস্তান্তর করেছে।
লাইলি বলেন, ‘আগে আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এইভাবে যে, আমি আমার মহামূল্যবান সম্পদের বিনিময়ে আর কিছুই না হোক, আমার দেশের স্বাধীনতা তো পেয়েছি। কিন্তু আজ আমি খুবই খুশি যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমার ত্যাগের মূল্যায়ন করেছেন। তিনি আমাকে শুধু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিই দেননি। আমিসহ আমার পরিবারের জন্য একটি সুন্দর বাড়িও উপহার দিয়েছেন তিনি। আমি প্রধানমন্ত্রীর জন্য সব সময় দোয়া করি, তাঁর হাতেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সঠিক পথে চলছে।’
কথা প্রসঙ্গে লাইলি বললেন, ‘এখন আর আগের মতো কষ্টে দিন কাটাই না। ভালো একটি বাড়িতে থাকি। প্রতি মাসের ১০ হাজার টাকা ভাতা। সবকিছু মিলিয়ে বলতেই হবে ভালো আছি।’
১৯৭১ সালের সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই লাইলি জানালেন, পাক বাহিনীর পৈশাচিকতার কথা মনের ভেতরে আনতে চান না তিনি। কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে পড়ে সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি। নিজের অজান্তেই কেঁপে কেঁপে ওঠেন তিনি।
দিন, তারিখ কোনোকিছুই বলতে পারেন না তিনি। তার শুধু মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেকোনো একদিন দুপুরে তিনি ছিলেন গৃহস্থালি কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। অথচ ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তিনি যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জীবনে কী দুঃসহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই যখন তিনি হানাদারদের পশুত্বের শিকার হলেন, তিনি মর্মে-মর্মে অনুভব করতে বাধ্য হলেন বর্বর পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা আর পৈশাচিকতার মাত্রা।
লাইলি জানান, মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় শ্রীপুরের মদনপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেনের সাথে। বিয়ের পরবর্তী বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার স্বামী যশোর অঞ্চলে ৮নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর শ্রীপুর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেন মিয়ার দলে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একইসাথে যুদ্ধে যান তার দেবর মশিউর। পাক সেনাদের শ্রীপুর অঞ্চলের ক্যাম্পটি ছিল তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি। যুদ্ধের শেষভাগে এক দুপুরে লাইলির জন্য অভিশাপতুল্য ওই দিনটিতে সশস্ত্র পাক হানাদাররা ঝড়ের বেগে প্রবেশ করে মদনপুর গ্রামে। তার স্বামী মনোয়ারসহ গ্রামের পুরুষ মানুষগুলো জীবন বাঁচাতে যে যার মতো পালিয়ে গেলেন। যার যার বাড়িতে পড়ে রইলেন গ্রামের সন্ত্রস্ত মহিলারা। লাইলিসহ ৭/৮ জন মহিলা আশ্রয় নিলেন তাদের গ্রামের হানাদার বাহিনীর দালাল স্থানীয় ’পিস্ কমিটি’-র সদস্য অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল আযমের বাড়িতে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদাররা ওই বাড়িতে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়া সমস্ত মহিলাদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলে।
দুঃসহ স্মৃতি আক্রান্ত লাইলি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘এ সময় অন্য মহিলাদের বাঁচাতে আনোয়ারুল আযমের মা আমাকেই পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।’
এরপর হানাদাররা তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে ওই বাড়ি থেকে। অন্য ধরনের ঝড় বয়ে যায় লাইলির জীবনে। তার আর্ত-চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও পশুদের উন্মত্ততা থামেনি। এক পর্যায়ে পশুর দল তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়।
হানাদাররা গ্রাম ত্যাগ করার পর তার স্বামী মনোয়ার বাড়িতে এসে তাকে উদ্ধার করে গ্রাম্য ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করান।
কথা প্রসঙ্গে লাইলি বেগম বললেন, ‘যেহেতু আনোয়ারুল আযমের মা আমাকে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল, আমি তাকে অভিশাপ দিয়েছি অনেক। কিন্তু দেশ স্বাধীনের কিছুদিনের মধ্যে ওই মহিলা মারা যাওয়ার পর আমি তাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিই।’
(ঢাকাটাইমস/২৬মার্চ/প্রতিনিধি/জেবি)
মন্তব্য করুন