বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চান পিরোজপুরের লক্ষ্মী রাণী

সৈয়দ মাহ্ফুজ রহমান, পিরোজপুর থেকে
 | প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০১৭, ১৯:২৫

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাননি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শাখারীকাঠী গ্রামের লক্ষ্মী রাণী মণ্ডল। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী গাবতলা গ্রামের লালু মণ্ডলের সাথে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একাত্তরের বর্বোরচিত আক্রমণে মা-বোনের সম্ভ্রম, লাশের মিছিল আর স্বজন হারানোর বেদনার আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। বাঙালি নামধারী কিছু বর্বর রাজাকার পাকিস্তানিদের সাথে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী। তাদেরই সহযোগিতায় দেশে লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগে মেতে উঠেছিল। তেমনি একদিন লক্ষ্মী তার মা ও ভাইবোনদের সাথে ঝোপ-জঙ্গলে পালিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি স্থানীয় রাজাকারদের দৃষ্টি থেকে।

বাঙালি রাজাকারদল নারীদের উপঢৌকন হিসেবে পাক-বাহিনীর হাতে তুলে দিত। এমনি করেই দীর্ঘ নয় মাসে বহু রক্ত ও মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা। স্বামী, সংসার, সমাজ থেকে বিচ্যুত অনেকের ন্যায় পিরোজপুরের লক্ষ্মী রাণী তারই একজন। তাকেও সেইদিন টেনে-হিঁচড়ে তুলে দেয় পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে। পরে ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে লক্ষ্মী রাণী। তিনি মৃত্যুর আগে স্বীকৃতি, সম্মানটুকু ফিরে পেতে চান।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরঙ্গনাদের ‘মা’ সম্বোধন করেছিলেন। বীরাঙ্গনাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ও সেই অনুযায়ী ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে ধর্ষিতা নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে শুরু করেছিলেন তাদের পুনর্বাসন। ১৯৭৩ সালে সিরাজগঞ্জের এক জনসভায় ৩৫ জন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে মঞ্চে উঠে তাদের মা বলে সম্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সিরাজগঞ্জের প্রতিষ্ঠা করেন বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্রসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও নিরপরাধ বীরাঙ্গনা মা বোনদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা হয়।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমান জারি করে সব পুনর্বাসন কেন্দ্র বন্ধ করে দিলে শুরু হয় বীরাঙ্গনাদের জীবনে নতুন বিড়ম্বনার। সমাজ থেকে বিচ্যুত, স্বামী সংসার থেকে পরিত্যক্ত হওয়া মা বোনেরা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। এমনই দুঃখ, কষ্ট আর একবুক ব্যাথা নিয়ে অনেক বীরাঙ্গনা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল গত ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ২৪ তম সভায় বীরাঙ্গনা মা-বোনদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সেই ঘোষণার তিন বছর পার হলেও আজও তার নাম তালিকায় ওঠেনি।

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেলেন দোসর রাজাকারদের ঘৃণিত লালসার শিকার পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শাখারীকাঠী গ্রামের বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী রাণী মণ্ডল।

সম্প্রতি কথা হয় লক্ষ্মী রাণীর সাথে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র দেড় মাস আগে ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছির পার্শ্ববর্তী গাবতলা গ্রামের লালু মণ্ডলের সাথে, পেশায় কৃষক। ওইসময় তিনি (কৃষক লালু) আমাকে (স্ত্রী) রাজাকার ও পাক-হানাদারদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালান। তার নিজের বাড়ির এলাকায় রাজাকারদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেপ্টেম্বরের কোনো এক সোমবার তাদের (লক্ষ্মী) বাড়ির কাছের বেলুয়া নদীতে পাক সেনাদের গানবোট এসে নোঙ্গর করে। প্রাণভয়ে সবাই ঝোপ-জঙ্গলে পালিয়ে যে যারমতো আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। সেদিন হানাদার ও রাজাকাররা ১২ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করছিল। অন্যদের মতো লক্ষ্মী রাণীও তার মা, ভাইবোনদের সাথে ঝোপ-জঙ্গলে পালিয়ে থাকলে দেখে ফেলে স্থানীয় রাজাকাররা। তাকে সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে তুলে দেয়। সারারাত পাশবিক নির্যাতনের পর জ্ঞানহীন দেহটা নদীর তীরে ফেলে রাখে।

এসব ঘটনা শুনে স্বামী তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঠাঁই হয় পিতা ললিত রায়ের অভাব অনটনের সংসারে। পরে নিরুপায় প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন।

তিনি বলেন, পরে শুনছিলাম তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুনে ৭১’র দুঃখ-কষ্ট ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। মনে সেই স্বামী সংসার হারা দীর্ঘ ব্যাথা কষ্ট। তিনি বলেন, আমারতো কোনো অপরাধ ছিল না, স্বামীর সংসারে সুখের দিন আমার কপালে সইলো না।

গত ২০১৩ সালের স্বাধীনতা দিবসে তৎকালীন পিরোজপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শামিমুল হক ছিদ্দিকী সেই প্রথম তার হাতে আর্থিক সহযোগিতাসহ সম্মাননা তুলে দিয়েছিলেন।

তবে এখনো তিনি বিরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাননি। সংসার, সমাজের কাছে হেয়-প্রতিপন্ন লক্ষ্মীরা বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চায়, সন্মান চায়, এ সন্মান নিয়ে মরতে চায়।

নাজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রেজাউল করিমের সাথে বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী রাণীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রবিবার বিকালে ঢাকা টাইমসকে জানান, এ নামে কাউকে চিনি না এবং কোনো সম্মাননাও দেয়া হয়নি।

(ঢাকাটাইমস/২৬মার্চ/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :