এক পাকিস্তানির চোখে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ
সাইয়্যেদ মানজার আহমদ পূর্ব পাকিস্তানে জহুরুল ইসলামের সমমানের শিল্পপতি ছিলেন। জহুরুল ইসলাম টয়োটা গাড়ির এজেন্ট, আর তিনি ছিলেন ডায়হাটসো গাড়ির এজেন্ট। এই সুবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদসহ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছিল তার সখ্য। তিনি উর্দু ভাষায় ‘পাস মানজার’ নামে আত্মজীবনীতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তার দেখা চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের কথাও তুলে ধরেছেন। বর্তমানে পাকিস্তানে বসবাস করছেন সাইয়্যেদ মানজার আহমদ। পাঠকদের জন্য এই পাকিস্তানি নাগরিকের দেখা চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হলো। যা উর্দু থেকে অনুবাদ করা হয়েছে- লেখক
২২ মার্চ রাত প্রায় আটটায় ঢাকা হতে পিআইএতে চাকরিরত আমার এক বন্ধু আবদুর রহমানের ফোন আসে। বললেন, যতটুকু সম্ভব আজই বাজার থেকে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে রাখুন। কেননা, জানতে পেরেছি- ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতাদের বন্দি করে পূর্ব পাকিস্তান সৈন্যদের হাতে তুলে দেবে। যদি তাই হয়, তখন দেশে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হবে। কেউ কারো অবস্থা জিজ্ঞেস করার থাকবে না। অ্যাডমিরাল আহসান ও জেনারেল ইয়াকুব আগেই সরে গেছেন। এখন জেনারেল টিক্কা খানের হাতেই চূড়ান্ত ক্ষমতা। ইচ্ছেমতো পাকিস্তানের রাজত্ব করবেন। শুনেছি, ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রয়োজনে লাখ লাখ লোক হত্যা করতে হলেও তিনি পিছপা হবেন না- এমনটিই তার চিন্তা।
রাত দশটা বাজতেই আমার কাছে কয়েকটি ফোন আসে। তারা জানায়, আপনার বাড়ির পাশে ওম্যান কলেজ ও নির্মাণাধীন মসজিদের কোণে আওয়ামী লীগের শত শত কর্মী সমবেত হয়েছে। তাদের প্রোগ্রাম হচ্ছে, রাত বারোটা বাজলেই ২৩ মার্চ শুরু। তখন ইপিআররের জোয়ানরা নিজেদের ক্যাম্পে অবাঙালি সেনাদের আক্রমণ করবে। ফায়ারিং শুরু হবে। তখন এ এলাকায় বসবাসরত অবাঙালিদের হত্যা করা হবে। লুট করবে তাদের বাড়িঘর।
প্রয়োজনে জ্বালিয়েও দিতে পারে। কারণ, কেউ যেন জীবিত না থাকে। এ সংবাদে আমি বেশ উৎকণ্ঠাবোধ করি। বিছানা ছেড়ে পোশাক পাল্টাই। ঘরের সবার বারণ সত্ত্বেও বেরিয়ে আসি। বের হওয়ার সময় ঢোকার দরোজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দিই। দেরিতে ফিরলেও যেন কারো কষ্ট করতে না হয়।
হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গেলাম। বাস্তবেও সেখানে কয়েক হাজার আওয়ামী লীগকর্মী সমবেত ছিল। সবার হাতে লাঠি, বল্লম, কাঁচি, হত্যা করার আরো নানা রকম হাতিয়ার। কয়েকজনের হাতে বন্দুকও ছিল। ঘন অন্ধকারে কারো চেহারা চেনা ছিল বেশ মুশকিল। আমাকে দেখেই কয়েকবার হাঁক দেয়- বিহারি এসেছে। সবাই আমার দিকে ফিরে তাকাল।
এলাকার একজন বেরিয়ে অন্যদের বলল, এতো মনজুর সাহেব দেখছি। বেশিরভাগ বাঙালিই আমাকে মনজুর সাহেব বলে সম্বোধন করত। সে উচ্চৈঃস্বরে বলল, খবরদার! কেউ মনজুর সাহেবের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে না। পরে জানতে পারি, তিনি এলাকার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি।
আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি খেয়েছ? তারা উত্তর করল, সেই বিকেল থেকে এদিক-সেদিক লুকিয়ে আছি। এই মাত্র রাস্তায় বেরুলাম। তাই খাবারের সুযোগ পাইনি। আমি পাঁচ টাকা নোটের একটি বান্ডিল বের করে তাদের দিই। আর বললাম, কোথাও কিছু পাওয়া গেলে নিয়ে আস।
সেক্রেটারি একজনকে নির্দেশ দিলেন, দুজন সঙ্গে নিয়ে যাও। কোনো বাঙালির দোকান থেকে বিস্কুট বা খাবার জিনিস- যা পাওয়া যায়, নিয়ে আস। ছেলেরা একটি বেকারি দোকান থেকে খাবার কিনে দ্রুত ফিরে আসে। তারা খাবার শুরু করে। খাবার তখনো শেষ হয়নি। হঠাৎ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে নানা রকম অস্ত্রের ফায়ারিংয়ের শব্দ কানে বাজে। গুলির শব্দ শুনে শংকিত হয়ে উঠি। বাথরুমে যাওয়ার অজুহাত করে বাসায় ফিরে আসি।
আমার সাধ্যানুযায়ী প্রতিবেশী প্রতিটি ঘরের খোঁজ নিতাম। তাদের বলতাম, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে বলবেন। কেউ সাড়া দিত না। কেবল একটি ঘরের একজন মহিলা বলল, আমার বাচ্চার একটু দুধ দরকার। আমি দুধসহ অন্যান্য জিনিস তার ঘরের দরজার সামনে রেখে আসি। তারপর ঘরের পেছনের দরজায় গিয়ে বলে আসি, জিনিসপত্র দরজার সামনে রাখা। নিশ্চিত হয়ে মন চাইলে দরজা খুলে নিয়ে নেবেন। আমি চলে যাচ্ছি।
২৬ মার্চ প্রায় এগারটায় চট্টগ্রাম রেডিও পাকিস্তান ইপিআর’র দখলে চলে যায়। চারদিকে ইপিআর’র গাড়ি চলাচল করছে। মফস্বল থেকে বাস-ট্রাকে চড়ে লোকজন চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে সমবেত হচ্ছে। পাকিস্তান আর্মি প্রশাসন শেষ হয়ে গেছে।
দিনদিন চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি সৈন্য বাড়তেই থাকে। সেই সঙ্গে বাঙালি পরিবারের আশ্রয়ও আমার বাড়িতে বাড়তে থাকে। এক সময় আমার বাড়িতে তাদের সংখ্যা প্রায় একশ হয়ে যায়। তাদের রুচিমতো আপ্যায়ন করা ছিল আমার জন্য জরুরি বিষয়। কারণ, এ পরিস্থিতিতে দুঃখ হচ্ছিল।
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহতায়ালা আমার স্ত্রী সুফিয়াকে প্রচুর ধৈর্য দিয়েছেন। একইভাবে তাকে অল্পেতুষ্টি এবং আতিথেয়তার গুণও দান করেছেন। তার মন এমন উদার- নিজের গ্রাসও অভাবীদের দান করে দিয়ে থাকে। সে সবাইকে এমন আদর-আপ্যায়ন করেছিলÑ আজো তারা তা স্মরণ করে।
বাঙালি পরিবারের একজন লুকিয়ে নিজ গ্রামে যাত্রা করে। কারণ, যেন বাড়ির লোকদের কুশল জানাতে পারে। রাস্তায় সৈন্যদের গুলি তার পাজরের কাছে লাগল। অনেকক্ষণ সে ছটফট করে। পরে একজন তার কথায় আমার বাড়ির বাইরের গেটে ফেলে যায়। তার চিৎকার শুনে আমি ঘর থেকে বের হই। তাকে দ্রুত ঘরে নিয়ে আসি। অবস্থা ছিল তার শোচনীয়। বেশ রক্তক্ষরণ হয়।
ভাইজানের পরিচিত এক রুশ ডাক্তারকে ফোন করা হলো। তিনি নিজের গাড়িতে চড়ে আমার বাসায় আসলেন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর সেই ডাক্তার নিজের হাসপাতালে ভর্তি করতে সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
এ সময় মুহাজির ও পাকিস্তানপন্থি বাঙালি যুবকদের দুটি দল তৈরি করা হয়েছিল। সৈন্যরা তাদের একটির নাম রাখে আলবদর, আর অন্যটির নাম ‘আলশামস’। তাদের কয়েক দিনের ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিবাহিনীদের গণহত্যার অনুমতি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ বোকা ছেলেরা গ্রামে ব্যক্তিগত শত্রুতা ও লুটপাটের জন্য সাধারণ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করতে শুরু করে।
তাই গ্রামগঞ্জের বাঙালিরা জীবন ও সম্মান রক্ষা করতে দলে দলে ভারতে চলে যেতে শুরু করল। এতে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী অবাঙালিদের এমন দুর্নাম হলো- আজো বাংলাদেশে অবাঙালিদের বিশ্বাস করা হয় না। এসব কারসাজি সৈন্যরা অপরিপক্ব বুদ্ধি এবং নিজেদের জীবন বাঁচাতেই করেছিল।
আলবদর ও আলশামসের ছেলেদের অনৈতিক এবং অমানবিক পদক্ষেপেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবশ্য তখন সামরিক বাহিনীরও তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিছুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা ও জোয়ানও এ লুটপাটে অংশ নিয়েছিল। লুটপাট তখন বিশাল লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। ঘর লুট করা হলে- সোনা, রূপা ও নগদ অর্থ সেনাবাহিনীর ভাগে পড়ত। যার খেসারত পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালি পরিবার আজো দিচ্ছে। তাদের দুরবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান বা বর্তমান পাকিস্তান সরকারের এতটুকু অনুশোচনা নেই।
চট্টগ্রাম শহরে সৈন্যদের শাসন পুরোপুরি চালু হওয়ায় আমারও সমস্যা দেখা দিতে থাকে। যেমন আমার একেবারে নতুন মার্সিডিজের কথা চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবাই জানতেন। সৈনিকরা ব্যক্তিগত কাজে কিংবা রাতে আনন্দ-ফুর্তির আসর জমাতে আমার মার্সিডিজ দুটি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরত।
কয়েকদিন পর আমার কাছে বাঙালিদের ফোন আসে। বলল, আপনি তাদের অনৈতিক ও অমানবিক কাজে কেন সহযোগিতা করছেন? এতে চিন্তিত হয়ে পড়ি, কি করা। সৈন্যদের গাড়ি দিতে অস্বীকার করলেও আমাকে তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
নয়তো চট্টগ্রামে সব লুটপাট ও অনৈতিক কাজের জন্য অকারণে আমাকে দায়ী করা হবে। এ দোষ থেকে যেন বাঁচতে- তাই গাড়ি দুটি জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করি। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতে গাড়ির অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। একজন নৌবাহিনীর কমান্ডার মার্শাল ল’ কোর্টের বিচারক ছিলেন। আমি তার সহযোগিতা চাই। তিনি অনুরোধ করে অনুমতি নিয়ে দেন। কিন্তু এ কথা নেভি কর্মকর্তাদের ছাড়া আর্মি অফিসাররা জানত না। এ সুযোগে আমি রাতারাতি গাড়ি দুটি জাহাজে উঠিয়ে দিই। পরদিন জাহাজ যাত্রা করে। তারপর থেকে সৈন্যদের সঙ্গে আমার সম্পর্কে ভাটা পড়তে থাকে।
এক রাতে একজন লেফটেন্যান্ট এক বাঙালি মেয়ের ঘরে জোর করে ঢুকে যায়। বাবা-মায়ের সামনে সে তার সম্ভ্রম হরণ করল। মেয়েটির বাবা-মা কেঁদে আমার কাছে অভিযোগ করল।
লেফটেন্যান্টের নামও জানালো। আমি করাচি নৌবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফকে ফোনে ঘটনা জানাই। পরে এ নিয়ে কোর্ট মার্শালে মামলা হয়। এমন ঘটনা অসংখ্য ঘটেছে। আবার সেনাবাহিনীতে কিছু ভালো লোকও ছিল, যারা বাঙালিদের সহযোগিতা করতে সারাক্ষণ প্রস্তুত থাকত। খুব সদয় ব্যবহার ছিল তাদের।
তারপর ১৯৭১ সালের ১৭ মে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসি। একইদিন সন্ধ্যায় আমরা করাচি পৌঁছে যাই। তারপর আমার জীবন পাকিস্তানের সঙ্গেই সম্পৃক্ত।
লিয়াকত আমিনী : লেখক ও সাংবাদিক
ঢাকাটাইমস/২৭মার্চ/এলএ/টিএমএইচ