আইনজীবী সমিতির নির্বাচন; একটি পোস্টমর্টেম

আশিক রন
 | প্রকাশিত : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৯:৩২

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ইলেকশনে শেষমেশ হেরেই গেল আওয়ামী প্যানেল। শতচেষ্টা সত্ত্বেও ঠেকানো গেল না পরাজয়টা। যারা আদালত পাড়ার রাজনীতির নিয়মিত খবরাখবর রাখেন তারাসহ দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুমিত-ই ছিল এই পরাজয়। তজ্জন্যই পরাজয় এড়ানোর তোড়জোড়টা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। কিন্তু তাও শেষরক্ষা হলো না। হতাশ অনেকেই, হতাশ আমিও। সেই হতাশা থেকেই বিবেকের ফরমায়েশ থেকে একজন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী হিসাবে আমার এই পোস্ট-মর্টেম।

নানান বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পেশাজীবী সংগঠন- আইনজীবী সমিতি, যে সমিতিগুলোর নেতৃত্বে দীর্ঘদিন যাবৎ আওয়ামী পন্থিদের আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। কিন্তু গত এক দশক ধরে বাজছে সারেঙ্গির উল্টো সুর। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট বার, ঢাকা বারসহ দেশের প্রায় অধিকাংশ বারেই বিএনপি-জামায়াতীদের আধিপত্য বাড়ছে ক্রমশ।

সংশ্লিষ্টগণের সাতসতেরো বিশ্লেষণ থেকে যতদূর বুঝি তা হচ্ছে দীর্ঘসময় ধরে নেতৃত্বদানকারী সিনিয়র আইনজীবীদের বড়ো একটা অংশ হয় গেছে স্বেচ্ছা নির্বাসনে নয়তো হয়ে গেছে পরিত্যক্ত, অযোগ্য ও হাইব্রিডদের পবনগতির বানের তোড়ে। আর বর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা বিভক্ত আবার দুই প্রধান শিবিরে, হয় আওয়ামী আইনজীবী নয় বঙ্গবন্ধু আইনজীবী ব্যানারে। নেত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এই দুই ধারার বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রয়োজনে ভোটটা বিএনপি-জামায়াতীদের দেবো তাও অপর শিবিরকে নয়। এই বিভাজন ব্যতীতও দল ক্ষমতাসীন বলে নানান পাওয়া-না পাওয়ার খেদ-উৎসারিত ঝাল নির্বাচনকালে ঝাড়ার বিষয় তো আছেই।

আইনজীবীদের এই বিভাজন যতদূর বুঝি তা মোটেও আদর্শিক নয়। হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় অ্যাটর্নি ও পিপি-জিপি অফিসে পদ-পদবি বাগানো নিয়ে পদলেহনকারীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা হিসাবনিকাশ-ই এই বিভাজনের প্রধান কারণ। ভোটের রাজনীতিতে একের পর এক পরাজয় সত্ত্বেও এই সকল পদ-পদবি দখল করত সর্বোচ্চ সুবিধা হাসিলের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেদের আখের গুছিয়ে চলেছেন দুই শিবিরে বিভাজিত প্রধান নেতারা কিংবা তাদের অনুসারীরা সকলেই। কিন্তু ক্ষমতার মসনদ উলটালে নিশ্চিত জেলের ঘানি টানবেন নেত্রীসহ গুটি কয়েক শীর্ষ নেতা এবং রাজপথের ত্যাগী ও সদা বঞ্চিত নেতাকর্মীরাই। অার এতদিনকার ইতিহাস বলে, সে সময় উলটারথের নিরাপদ যাত্রী হবেন এই মধুলেহীরা বরাবরের মতোই। আতঙ্কটা আমার সেখানেই!

অভ্যন্তরীণ বিভাজন বা গ্রুপিং আমাদের মতো দেশের সকল রাজনৈতিক দলেই হয়ে থাকে কমবেশ, ক্ষমতাসীন দলে হয় একটু-আধটু বেশি। কিন্তু কেবল আইনজীবী সংগঠনেই নয়, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দলাদলির রমরমা ব্যাপ্তি কিন্তু দলটির জেলা-উপজেলা শাখাসহ অঙ্গসংগঠনের সকল স্তরেই। তাছাড়া প্রথাগতভাবে তো চলছেই শাখা কমিটিগুলোর নিয়মিত সম্মেলন না হওয়া, সম্মেলনের বহুদিন পর ঢাকা থেকে পকেট কমিটি নির্বাচন করা, নির্বাচিত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে কমিটির অন্য পদগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ইজারা প্রদান করা। ফলে প্রয়োজন পড়ছে না আর কোনো ত্যাগী নেতাকর্মীর কিংবা প্রয়োজন পড়ছে না কোনো ত্যাগ-তিতিক্ষার, বরঞ্চ সে সবের স্থলে সর্বত্রই গড়ে ওঠেছে নেতা তোষণের এক অদ্ভুত সংস্কৃতি গত কয়েক দশক ধরে। তাতে দল হয়েছে দুর্বল দিনেদিনে। চলছে দিব্যি এখনও।

সরকার হয়তো এযাবৎকাল চলছে নেত্রীর একক কারিকুরিতে, চলবে হয়তো আরেকবার কিংবা চলুক বার বার। কিন্তু সদা কূটকৌশলকারী একটা শক্তিশালী বিরোধী জোট যেমন আছে সর্বদা ওত পেতে, তেমনি আছে দেশি-বিদেশি নানামুখী ষড়যন্ত্র। এছাড়া জঙ্গিবাদের জগদ্ব্যাপী জোয়ার তো এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলেছে এই দেশকেও দিনেদিনে। সে সব অশুভ শক্তি মোকাবেলায় সাংঠনিকভাবে জরাজীর্ণ জোড়াতালির একটা দল নিয়ে নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রামগ্ন হবার অবকাশ কই! টেনশন কেবল আমার একার নয়, সব মিলিয়ে টেনশনটা আওয়ামী লীগ পন্থি প্রায় সকলেরই। আমি অকালপক্কের টেনশনটা হয়তো প্রকাশিত, অন্যদেরটা অগোচরে, আক্ষেপ করা পর্যন্তই ব্যাপ্তি যার।

অথচ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসা এই দলটার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল প্রগতিবাদী আদর্শিক আন্দোলনের তকমা। কি নেই দলটার! আছে বিপুল জনসমর্থন, আছে তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক ব্যপ্তি, আছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস-ঐতিহ্য, আছে গাদাগাদা স্বার্থত্যাগী অন্ধ ও তেতেপোড়া কর্মীবাহিনী। কিন্তু তার পরও সংশয় পিছু ছাড়েনি কখনও দলটার এই স্থলে যে, আগামীতে আবার আমরা ক্ষমতায় আসছি তো?

সংশয় এবং আতঙ্কটা আমার মতো দল-ভাবাবেগীদেরই বেশি। আর বেশধারী ক্ষমতার মধুলেহীরা এতাবৎকালে আহরিত সহায়সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী গড়ায় নিমগ্ন। মেয়াদের অবশিষ্ট সময়ে আর কি কি অর্থসম্পদ আর পদ-পদবি ব্যক্তিগত ঝুলিতে পোরা যায় সেসব নিয়েই চলছে তাদের নিরন্তর হিসাবনিকাশ। সে লক্ষ্যে কেবল নিজ বলয় শক্তিশালী করার মানসে দলের বারোটা বাজিয়ে যত কিছু করতে হয় তাতেও তাদের ভ্রুকুটি নেই। ফলে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হয় সদাসর্বদা আমার প্রিয় নেত্রীকে। পাহারা বসাতে হয় চোরা অলিগলিসহ নেতাদের সকল বিচরণ পথে। গণভবনে ডেকে এনে খুতবা দিতে হয় প্রতিনিয়ত কখনও নাসিক, কখনও কুসিক, কখনও ঢাকা বার আবার কখনও সুপ্রিম কোর্ট বার ইলেকশনে দল মনোনীতদের বিরোধী বলয়কে। তাও প্রায় সময়ই থলিতে আসছে না প্রত্যাশিত ফল।

প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কতবার কতশত নেতাকে ডেকে এনে খুতবা দিবেন নেত্রী। কতবারই বা কোন্দল মেটানোর পর্যাপ্ত সময় পাবেন দলের শীর্ষমহল। তাছাড়া আদৌ কার্যকর হচ্ছে বা হবে কি এই সকল চেষ্টার শতভাগ? ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পরবর্তী জাতীয় নিবার্চন কিন্তু সজোরে কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। আসন্ন এমন ঝড়ঝাপটা সামলাতে শীর্ণ দলটার সাংগঠনিক অধোগতি রুখতে হবে সবার আগে, যে কোনো মূল্যে; নতুবা নিশ্চিত পস্তাতে হবে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সকলকেই, এমনকি এই দেশকেও।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, খাদের এই কিনারা থেকে দলটাকে টেনে তুলতে পারবেন কেবলমাত্র আমার নেত্রী শেখ হাসিনা-ই। সকল দ্বন্দ্ববিরোধমাঝে জাগ্রত যে আলো সেই-তো নেত্রী! ফলে উপশমের কার্যকর পন্থা বের করতে হবে নেত্রী আপনাকেই। আমার মতো ভুখা-নাঙ্গা ভাবাবেগী কর্মীদের দৌড়ঝাঁপ তো ফেসবুকের টাইমলাইনে দুই-চার লাইন লিখে ভেতরের আক্ষেপ উগরে কিছুটা হালকা হওয়া অবধি, অতঃপর শ্রান্তদেহে নীড়ে ফেরা। আমাদের আর অত হিসাবকিতাব কিসের? দল সংহত থাকলে আমার মতো দীনহীনদের প্রাপ্তি তো কেবল চিত্তের তৃপ্তি, যে প্রাপ্তির মাপকাঠি নেই কোনো।

এতকিছুর পরও দিনশেষে আশাবাদী আমি। আমার নেত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা যতদিন আছে, যতদিন পর্যন্ত আছে লাখো লাখো ত্যাগী আওয়ামী নেতাকর্মী, ততদিন পর্যন্ত আছে থাকবে বহাল তবিয়তে আমার আশা। আর থাকবেই না কেন? যুগে যুগে এই রকম ত্যাগীরা লড়াই করেছে বলেই আজ দেশজুড়ে বইছে আওয়ামী বসন্তের হাওয়া। তাঁরা কস্মিনকালেও পথের বিচার করেনি, তাঁরা পাথেয়ের হিসাব রাখেনি কোনোদিন, তাঁরা ছুটে এসেছে সব সময় সময়ের প্রয়োজনে, তাঁরাই পথ বাতলেছে বারংবার। আমি তাঁদের একজন হয়ে থাকতে চাই আজীবন। অদূরভবিষ্যতে দল বা এর অঙ্গসংগঠনের কোনো পদে পদপ্রার্থী নই আমি।

সঙ্গত কারণে এই রকম আসন্ন কোনো কমিটিতে পদলোলুপদের কারও চক্ষুশূল হবার কথা নয় আমার। সুতরাং এই সমালোচনার ঘা সইতে না পেরে অযথা আমাকে অনুপ্রবেশকারী কিংবা জামায়াত-বিএনপি'র দোসর বানানোর প্রচেষ্টা আপাতত কারও জন্য কোনো শুভপ্রদ ফল বয়ে আনবে না। বরং নিজ নিজ দোষক্ষালনের প্রচেষ্টাই আমার-আপনার সকল আওয়ামী লীগারের জন্য আশু কল্যাণকর। জয় বাংলা।

লেখকঃ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :