বাংলাদেশ জঙ্গিবাদমুক্ত হবে, যদি...

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৭ মার্চ ২০১৭, ২৩:১৪

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নেই, এ কথা বলার আর কোনো সুযোগ নেই। জঙ্গিবাদের সাথে বিদেশি চক্রের কোনো সম্পর্ক নেই, এ কথাও বলা যাবেনা। সবাইকে এখন স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে। তবে বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদ তার অনাকাঙ্ক্ষিত অস্তিত্ব জানান দেয়নি। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া অর্থাৎ পৃথিবীর সব অঞ্চলেই জঙ্গিদের প্রাণঘাতি তৎপরতা আছে।

জঙ্গিরা পৃথিবীর সব দেশে আছে, সব ধর্মে আছে। তাই নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী কিংবা আক্রান্ত জাতি ভেবে হাত পা ছেড়ে দিয়ে স্টার জলসা জাতীয় চ্যানেলের কাছে আত্মসমর্পণ করলে হবেনা। সরকার, প্রশাসন, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, ব্যবসায়ী, এমনকি যে ব্যক্তি রিকশা চালিয়ে জীবিকা উপার্জন করে তারও ভূমিকা আছে রাষ্ট্রকে সঠিকপথে পরিচালনার বিষয়ে।

জঙ্গি কে? সে-ই জঙ্গি, যে রাষ্ট্রের আইন না মেনে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে। জঙ্গি সে-ই, যে মানুষকে বোমা মেরে, গুলি করে, পেট্রোল বোমা মেরে হত্যা করে, সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়। কোনো বিশেষ পোশাক বা অবয়বের মানুষকে জঙ্গি বলে সামাজিক-রাজনৈতিক কোণঠাসা করে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবেনা। গুলশানের রেস্তোরাঁর সন্ত্রাসী হামলায় কিন্তু আধুনিক কিংবা উত্তর আধুনিক পোশাক ও চুলের স্টাইল সম্বলিত ছেলেরাই অংশ নিয়েছিল। গুলশানের সন্ত্রাসীরা খুব ভালো ইংলিশ জানত। তাই জঙ্গিবাদের স্থায়ী নির্মূল চাইলে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে রাষ্ট্রের পলিসি মেকারদের ভাবতে হবে। মানুষকে শুধু সচেতন করলে হবেনা। কী কারণে একজন মানুষ জঙ্গি হচ্ছে, কোন পরিস্থিতি তাকে জঙ্গি বানাচ্ছে, কারা সেই ব্যক্তিবর্গ যারা ছেলে-মেয়েদের ব্রেইন ওয়াশ করছে, কারা ছেলে-মেয়েদেরকে বিপথে নিচ্ছে ইত্যকার সব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে এই সমস্যার সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। আমাদের পুলিশ ও আর্মির সাহসী ও চৌকশ সদস্যরা জানবাজি রেখে একের পর এক জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস করছেন। কিন্তু এগুলো সাময়িক সমাধান। চরম সংকটে এরা আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু সমাজের প্রতিটি সদস্য যদি সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নিজেকে রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য নাগরিক ভেবে বেঁচে থাকার অবলম্বন পান এবং বিপথে না যায় তাহলে আর্মি, পুলিশের এত বড় ঝুঁকি নিতে হবেনা।

বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা সম্ভব। কারণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ইতিহাসের যে কোনো সময় থেকে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রদর্শন করছে। পাশাপাশি এদেশের মুসলিম, হিন্দুসহ সব ধর্মের মানুষের মাঝে জঙ্গিবাদবিরোধী শক্ত মনোভাব রয়েছে। যারা জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে, তারা সংখ্যায় কম, শক্তিতে দুর্বল। কিন্তু সমস্ত মহল সমানভাবে আন্তরিক না হলে, সচেষ্ট না হলে, জঙ্গিবাদের ভুত আমাদের খেয়ে ফেলবে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ তার পথ হারাবে। কিছু মানুষ বিদেশ চলে গিয়ে বাঁচতে চাইবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই দেশে থাকবেন। তাই নিজের দেশকে বাঁচাতে সবাইকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। শিক্ষিত, সুশীলরা, দেশের আলেম সমাজ সবাই এক টেবিলে বসে আলাপ-আলোচনা করেন। জঙ্গিবাদের কারণগুলো বের করুন।

ডাক্তার যেমন ওষুধ দেয়ার আগে বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে রোগের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওষুধ দেন, রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করছেন তাদেরও সেভাবেই কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো গলদ আছে কিনা। যারা মুখে মুখে চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, কিন্তু ঘুষের টাকা, টেন্ডারের টাকায় আলিশান হাভেলি বানাচ্ছেন, তাদের দুর্নীতিপরায়ণতা সমাজে কোনো অসংগতি সৃষ্টি করছে কিনা, সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে হবে। সমাজের নানাবিধ অসংগতি থেকে ছেলে-মেয়েদের বিপথে নেয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে কিনা তার অনুসন্ধান করতে হবে।

জঙ্গিবাদের স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। পুলিশ, আর্মির কাজ তারা করবেন। তারা জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস করতে পারবেন। নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে জঙ্গিদের রুখে দিতে পারবেন। কিন্তু জঙ্গিবাদকে কি সারাজীবনের জন্য হটিয়ে দিতে পারবেন। হ্যাঁ পারবেন, যদি সমাজে একটা সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষকে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত নাগরিক হিসেবে তৈরি করা যায়। যারা জঙ্গিবাদের সাথে জড়াচ্ছেন, তাদের কোনো অর্থনৈতিক কারণ আছে কিনা, খতিয়ে দেখতে হবে। জঙ্গিবাদের গুরুরা দারিদ্রের বা অন্য কোনো বঞ্চনার সুযোগ নিচ্ছে কিনা সে বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করতে হবে।

লেখার এ অংশে ‘আইএস’ নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই। সরকার ‘আইএস’ এর অস্তিত্ব স্বীকার করতে চান না। সরকারের নিশ্চয়ই একটা ব্যাখ্যা আছে। আমার পরামর্শ হবে, আইএস আছে কি নেই, সে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে, ‘আইএস’ সংশ্লিষ্ট রাজনীতির দিকটি ক্লিয়ার করে দিলেই মানুষের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। চারদিকে এখন শুধু ‘আইএস’ ‘আইএস’ রব। কেউ খবর নিচ্ছে না, এই আইএস আসল কোত্থেকে। বাংলাদেশের জেলা-উপজেলায় ঘটনা ঘটে। কিন্তু এর কনফরমেশন আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সাইট ইন্টিলিজেন্স নামের প্রতিষ্ঠানটি কার তার একটু খোঁজ নেন। ইহুদিদের পরিচালিত এই সংগঠনের সাথে বাংলাদেশের কার কার যোগাযোগ আছে, তার একটু খোঁজ নেন। পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসকারী সরকারিবিরোধী বাংলাদেশিদের মধ্যে কোনো গোষ্ঠী আছে কিনা, যারা সাইট ইন্টেলিজেন্সের সাথে যোগাযোগ রাখছে, এ বিষয়ে সরকারকে তালাশ করতে হবে।

সবাই একটু খেয়াল করুন। এখন আর আল-কায়েদার নাম শোনা যায় না। কারণ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো আল-কায়েদাভিত্তিক সংবাদ আর দেয় না। এখন নতুন ধারণা আইএস’র প্রচার ও প্রসার চলছে। আল-কায়েদার আইডিয়া ব্যবহার করে আফগানিস্তান এবং ইরাকের পাইপ লাইনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়া যাচ্ছে না সিরিয়া এবং ইরানের জন্য। তাছাড়া সিরিয়া এবং ইরান উভয় রাষ্ট্রই জোর করে বানানো রাষ্ট্র (?) ইসরায়েলের জন্য ‘হুমকি’। বর্ধিত ইসরায়েলের অমানবিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্রোহী রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে একটা যুৎসই আইডিয়া হিসেবে কাজ করছে ‘আইএস’ এর ধারণা। সিরিয়া সংকটের দিকেই মনোনিবেশ করুন, আইএস’র ধারণা আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে। রাশিয়া যখন বাশার আল আসাদের পক্ষে ‘আইএস’ মেরেছে বলে দাবি করে, তখন পশ্চিমা মিডিয়া নিউজ প্রচার করে ‘রাশিয়ার বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহত’। সিরিয়ার সেনাবাহিনী যখন ‘আইএস’ মারে, তখনো একই শব্দ আর ভাষার ব্যবহার থাকে। আবার ন্যাটো বাহিনী যখন হামলা করে, তখন প্রচার করা হয় ‘আইএস জঙ্গি নিহত’। সিরিয়ার সেনাসদস্যরা যখন নিহত হয়, তখন হামলাকারীদের পরিচয় থাকে “rebel” বা বিদ্রোহী, ‘আইএস’ সেখানে অনুপস্থিত। জঙ্গিবাদের স্থানীয় এবং বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে সরকারকে নিজে ক্লিয়ার হয়ে জনগণকে সেভাবেই বোঝাতে হবে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করার সুযোগ দেয়া যাবেনা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :