লটারির খপ্পরে সর্বস্বান্ত বগুড়ার মানুষ

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
| আপডেট : ২৮ মার্চ ২০১৭, ১১:৫৫ | প্রকাশিত : ২৮ মার্চ ২০১৭, ১১:৩৬

কি মামা খুশিতো? এই একটি ডায়ালোগেই টিকিট কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বগুড়াসহ আশপাশের জেলার মানুষ। লোভনীয় পুরস্কারের আশায় খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সববয়সী মানুষ কিনছেন টিকিট। এই সুযোগে হাজার হাজার মানুষ সর্বশান্ত হলেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মেলা কর্তৃপক্ষ। বগুড়ার মান্নান এই অবৈধ লটারির মূল হোতা। লটারির খপ্পর থেকে বাদ যাচ্ছে না স্কুলগামী শিশু শিক্ষার্থীরাও।

জানা গেছে, বগুড়া শিল্প ও বণিক সমিতির উদ্যোগে জেলার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম সংলগ্ন ফাঁকা এলাকায় গত ১ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। মেলায় আন্তর্জাতিক স্টলের সংখ্যা যেমন তেমন হলেও প্রধান আকর্ষণ ‘দৈনিক স্বপ্নছোঁয়া র‌্যাফেল ড্র” নামে লটারি। প্রতিদিনের লটারিতে রাখা হয়েছে লোভনীয় পুরস্কার। বগুড়া ও আশপাশের জেলায় প্রতিদিন বিক্রি করা হচ্ছে কোটি টাকার টিকিট। জনগণকে প্রলুব্ধ করতে দৈনিক ক্যাবল টিভিতে দেখানো হচ্ছে লটারির ড্র।

ক্যাবল টিভিতে অবৈধভাবে সরাসরি ড্র’তে লটারি পরিচালকের আকর্ষণীয় বাচন ভঙ্গি ও লোভনীয় পুরস্কারে আসক্ত হয়ে পড়েছে মেলা ও মেলার বাহিরের এক শ্রেণির মানুষ। বাদ যাচ্ছেন না খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও।

আগামী ২ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা। কিন্তু কেবল টিভিতে অনুষ্ঠান দেখে বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এফজেড, ফিজার আর এপাচির চিন্তা মাথায় নিয়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে অনেক পরিক্ষার্থী রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত টিভির সামনে বসে থাকে। কখন রাজ্জাক মামা ফোন করে তাকে বলবে ‘কি মামা খুশি তো’। এজন্য তাদের পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

গত রবিবার মহান স্বাধীনতা দিবস ছিল মাসিক লটারির টিকিট বিক্রির দিন। মেলার শেষ দিন রাত নয়টায় সরাসরি ক্যাবল টিভির মাধ্যমে প্রচার করা হবে বলে টিকিটের পেছনে বলা হয়েছিল। মাসিক লটারির পুরস্কার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০১টি। যার প্রথম পুরস্কার প্রায় ১৭-১৮ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের টয়োটা এক্স করোলা ব্রান্ডের নিউ কার। শেষ পুরস্কার নগদ দুই লাখ টাকা। এছাড়া ১০টি মোটরসাইকেল, স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ মোট ১০১টি পুরস্কার নির্ধারণ করা হয়েছির। মাসিক টিকিট বিক্রির দিন টিকিট কিনতে হুমড়ি পড়ে যায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে লটারির টিকিট কাটা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

বগুড়া জেলা শহরসহ আশপাশের জেলা এবং উপজেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে এর প্রভাব পড়ে। টিকিট কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন খেটে খাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। ঝুঁকে পড়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ কমলমতি শিশুরাও। টিকিট না পেয়ে অনেকে কালোবাজারে ২০ টাকার টিকিট ১০০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয়।

গত রবিবার মাঝিড়া বটতলায় ইজিবাইকে করে টিকিট বিক্রি করতে আসা দুই জন কর্মী চার রংয়ের চারটি বান্ডিল করে টিকিট বিক্রির পসরা বসান। যার প্রতি বান্ডিলে একশ করে টিকিট ছিল। পুরস্কারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ ও মূল্যবান হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যেই টিকিট শেষ হয়ে যায়। পাশে রাখা হয়েছে টিকিটের মুড়ি রাখার ৩৭ নাম্বার বাক্স। কতগুলো টিকিট বিক্রি হয়েছে জানতে চাইলেও উত্তর মেলেনি।

এর আগে দৈনিক লটারির টিকিট দিতে না পারায় উপজেলার মাঝিড়া বন্দর, মাদলা, মালিপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষের হামলার শিকার হয়েছে টিকিট বিক্রিতারা। এক পর্যায়ে পুলিশ এসে উদ্ধার করতে হয়েছে তাদেরকে।

কতগুলো টিকিট বিক্রি করেছেন জানতে চাইলে রাজু নামের এক টিকিট বিক্রেতা বলেন, ‘মালিকই জানতে চায় না কি পরিমাণ টিকিট বিক্রি করি। আর আপনারা জানতে চান। কিভাবে বলি বলেন।’ আবু সুফিয়ান। স্থানীয় এক হোটেলে কাজ করে তিনি দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরি পান। টাকা পাওয়ার পরই তিনি প্রতিদিন ১০টি টিকিট কেনেন। কিন্তু মাস শেষ হয়ে এলেও এ পর্যন্ত তিনি কোনো পুরস্কার পাননি। তারপরও মেলার শেষ দিন পর্যন্ত টিকিট কিনতে চান তিনি।

এদিকে টিকিট না পেয়ে অনেককে আক্ষেপ করতেও দেখা গেছে। উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ক্ষুদ্র ফুলকোট উত্তরপাড়ার জুলেখা বেগম নামের এক দোকানী আক্ষেপ করে বলেন, ‘টিভিতে শুধু লটারির পুরস্কার পাওয়া দেখি। এদিকে কেউ টিকিট বিক্রি করতে আসে না। আসলে একদিন না খেয়ে থাকা লাগলেও টিকিট কিনতাম।’

মোজাম্মেল নামের ষাটোর্ধ এক গতরাতে উপজেলার দুবলাগাড়ী হাটে এক চা দোকানে টিভির সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে রাজ্জাক মামার মোবাইল কলের আশায় বসে আছেন। কয়টা টিকিট কিনেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাইলে একটাতেই পাওয়া যাবে। না পাওয়া পর্যন্ত টিকিট কেটেই যাবেন বলে জানান তিনি।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন আয়োজন করায় অনেক সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছেন। কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাজীবন নিয়েও তারা শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। অনতিবিলম্বে এসব বন্ধ করা না হলে পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়বহ ক্ষতি হবে বলে জানান তারা।

জানতে চাইলে বগুড়া পুলিশ সুপার আসাদুজ্জান বলেন, আমার বাসার সামনেই লটারির টিকিট বিক্রির মেলা বসেছিল। পরে লাঠিপেটা করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, লটারির নামে যা চলছে এটা মেনে নেওয়া যায় না। অনুমোদনহীন লটারি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও জানান তিনি। তবে তার কাছে ওই লটারি বন্ধের কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান।

ঢাকাটাইমস/২৮মার্চ/প্রতিনিধি/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :