কারাগারের রোজনামচা : পিতার সঙ্গে কন্যার সাদৃশ্য

মাহবুব রেজা
| আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১২:২০ | প্রকাশিত : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৫৬

‘জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজেদেরকে চীনপন্থি বলেও থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থি, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পি-ি করাচি যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামিভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলো সুবিধাবাদী।’

(কারাগারের রোজনামচা/শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫৭)

২ জুন, ১৯৬৬ সালে জেলে বসে বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত খাতায় দেশের টালমাটাল রাজনীতি নিয়ে নিজের গভীর পর্যবেক্ষণ আর দূরদৃষ্টির কথা লিখতে গিয়ে এ কথা লিখছেন। একই পৃষ্ঠায় ৬ দফা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে তিনি সে সময়কার কিছু বিভ্রান্তিকর রাজনীতিবিদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাঁকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।’

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগমথিত ভাষায় তাঁর উপলব্ধির কথা বলেছেন যা শুনে উপস্থিত শ্রোতারা নিজেদের কান্না চেপে রাখতে পারেননি। শব্দ করে কেঁদেছেন অনেকেই। শেখ হাসিনা নিজেও বেশ কয়েকবার তাঁর বক্তব্য থামিয়ে অশ্রু সংবরণ করেছেন। পিতার বন্দি জীবনের বেদনা, কষ্ট আর যাতনার কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি অজান্তে তাঁর নিজের বন্দি জীবনের সেই সব কষ্টের, বেদনার, যাতনার কথাই বলছিলেন? এ যেন পিতা-কন্যার এক সমার্থক জীবনের আলেখ্য। প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত সবার জন্য এ ছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

দুই.

১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) স্বাধিকারের দাবিতে ছয় দফা দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।’ ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি থাকার সময় বঙ্গবন্ধু যে দিনলিপি লিখেছিলেন ৩৩২ পৃষ্ঠার ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তা তুলে ধরা হয়েছে।

রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ২৮ মার্চ ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২৭ মিনিট ব্যাপ্তিকালের বক্তব্যটি নানা কারণে মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই থেকে উদাহরণ টেনে এনে আইয়ুব সরকারের নির্যাতন, শোষণ, হুমকির পাশাপাশি সেই সময়ের উত্তাল, কণ্টকময় দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে নিজ দলসহ অন্যান্য দলের কিছু সুবিধাবাদী নেতার বিভ্রান্তিকর অবস্থান তুলে ধরে বলেছেন, আমার পিতা বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি থেকে যেভাবে সেই সুবিধাবাদী নেতাদের অবস্থানকে কৌশলগত কারণে মেনে নিয়ে মাথা ঠা-া রেখে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন তা থেকে রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শিক্ষার আছে। বইটি বের করার সময় আমরা তাতে কোনো হাত দেইনি। এ কারণে দেইনি, নতুন প্রজন্মসহ যারা ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণা কর্ম করেন তাদের জানা উচিত রাজনীতির চরম উত্থান পতনে সর্বোপরি বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তথাকথিত সুবিধাবাদী নেতা ও আশপাশের ঘটনাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে সামাল দিয়ে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কিভাবে জাতিকে নিয়ে গেছেন তাঁর চূড়ান্ত গন্তব্যে। আমরা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি মানুষের ভেতরে দেশপ্রেম, আদর্শ, নীতি আর চূড়ান্ত গন্তব্য জানা থাকলে তার আর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিন.

‘শেখ রাসেল বুঝতেই চাইছে না, বাবা বাসায় যেতে পারবেন না। বাবা কারাগারে বন্দি! ও বাবার হাত ধরে বলছে, ‘বাবা বাড়ি চলো...।’ বাবা কাছে নিয়ে আদর করে রাসেলকে বললেন তোমার মা’র বাড়িতে তুমি যাও, আমি এখানেই থাকি! আমরা বুঝলেও শেখ রাসেল কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না...।’ রোজনামচা থেকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের কান্না চেপে রাখতে পারেননি। তাঁর সেই কান্না সংক্রমিত করেছে মঞ্চের সবাইকে। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, যে খাতা দুটি নিয়ে কারাগারের রোজনামচা বইটি লেখা, সেই খাতা দুটি জেলখানায় বাজেয়াপ্ত করা হয়। আর সে তথ্যটি পেয়েছিলাম এসবি রিপোর্ট থেকে। প্রশাসনের বিপক্ষে লেখার জন্য খাতা দুটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন এসবি রিপোর্টগুলো কালেক্ট করে রেখে দিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে খাতা দুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। খাতা দুটির নাম বঙ্গবন্ধু নিজেই দিয়ে গিয়েছিলেন। খাতা দুটির মলাটের ওপর লেখা ‘থালা বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল।’ বইটির নাম ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামটি আমার ছোট বোন শেখ রেহানার দেওয়া।

বঙ্গবন্ধুর কারারুদ্ধ দিনগুলোর স্মৃতিমন্থন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মা জেলখানায় যাওয়ার সময় বাবার জন্য বই আর খাতা নিয়ে যেতেন। কিছুদিন পর মা গিয়ে সেগুলো বাসায় নিয়ে এসে সযতেœ রেখে দিতেন। খাতাগুলো খুঁজে পাওয়া ছিল অদ্ভুত ব্যাপার। এগুলো আমরা দেখি তা বাবা-মা কেউই চাইতেন না।

বঙ্গবন্ধুর লেখা নিয়ে আরও বই প্রকাশ হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় এসবির বহু রিপোর্ট আমরা নিয়ে এসেছি। তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কী রিপোর্ট করেছে, তা নিয়েও আমরা কাজ করছি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১০০টি অভিযোগ করা হয়। এখান থেকে ২টি অভিযোগ নিয়ে মামলা হয়। আমরা এগুলো নিয়েও আগামীতে বই বের করব। বাবার লেখার পেছনে মায়ের ভূমিকা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মায়ের কথা বারবার মনে পড়ে। লেখার জন্য বারবার উৎসাহ দিতেন। যখনই বাবা গ্রেপ্তার হতেন, লেখার জন্য খাতা দিতেন এবং সেগুলো সযতেœ সংরক্ষণ করতেন।’

চার.

...‘ন্যাপের কোনো কোনো নেতা ৬ দফা গোপনে গোপনে সমর্থন করলেও লজ্জায় বলেন না, আর কেউ কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। দিন আসছে ৬ দফা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মেনে এদেশে রাজনীতি করতে হবে না। তবে রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন অনেকেই।’

(কারাগারের রোজনামচা/শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১২৫)

বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের বন্দি জীবন, বন্দি জীবনে নানারকমের রাজনৈতিক কোন্দলের সমাধান, সমালোচনাকারীদের সহ্য করা, দলীয় নেতাদের সঠিক সময়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া ও সুবিধাবাদী নেতাদের কৃতকর্মকে মনে রেখে তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার কথাও বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি দেশ স্বাধীনের পর এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কথায় কথায়, কারণে অকারণে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করাকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কত সমালোচনা! এটা হলো না, ওটা হলো না, নানা ধরনের কথা, কত কিছু। মনে হলো যেন সেই সময় ওনার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে করতে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, তাদের হাতকেই যেন শক্তিশালী করে দিল।’ শেখ হাসিনা বলেন, আর এখন আমার মাঝেমধ্যে এটাই মনে হয়, এই যে তার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা, নানা কথা লেখার মধ্য দিয়ে তার জীবনটাকে কেড়ে নেওয়ার পথটা অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ঘটানোর একটা যেন পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল অনেকেই। পরবর্তীতে তারা হয়ত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কী তারা হারিয়েছিলেন। সেই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যারা গভীর উপলব্ধি দিয়ে শুনেছেন তাদের অনেককেই আমি বলতে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভেতর দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে তিনি যখন কারাগারে বন্দি তখনকার রাজনীতির উত্থান-পতন, তথাকথিত সুশীল সমাজের ক্ষমতালোভী অভিভাবকবৃন্দের অপতৎপরতা, নেতাদের সুবিধাবাদী চরিত্র সর্বোপরি নিজ দলের কিছু নেতার ডিগবাজি-তত্ত্বের বিরুদ্ধে তাঁর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের নির্দেশনা। তারা বেশ প্রত্যয় নিয়ে একথাও বলছেন, পিতার বন্দি জীবনের সঙ্গে কন্যা শেখ হাসিনা কি তাঁর নিজের রাজনৈতিক চরাই উৎরাই পেরোনো বন্দি জীবনের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন!

৩১ মার্চ, ২০১৭

ইনসার্ট ১

‘মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাঁকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।’

ইনসার্ট ২ ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগমথিত ভাষায় তাঁর উপলব্ধির কথা বলেছেন যা শুনে উপস্থিত শ্রোতারা নিজেদের কান্না চেপে রাখতে পারেননি। শব্দ করে কেঁদেছেন অনেকেই। শেখ হাসিনা নিজেও বেশ কয়েকবার তাঁর বক্তব্য থামিয়ে অশ্রু সংবরণ করেছেন। পিতার বন্দি জীবনের বেদনা, কষ্ট আর যাতনার কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি অজান্তে তাঁর নিজের বন্দি জীবনের সেই সব কষ্টের, বেদনার, যাতনার কথাই বলছিলেন? এ যেন পিতা-কন্যার এক সমার্থক জীবনের আলেখ্য।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :