‘কারাগারের রোজনামচা’-চোখ ভিজে যায় অজান্তেই

মৌলি আজাদ
 | প্রকাশিত : ০২ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৪৭

বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই বইটি পড়ার ইচ্ছা জাগে । কিন্তু সামাজিক মাধ্যম থেকে জানতে পারলাম বইটির পাঠকের চাহিদার সঙ্গে যোগানের ব্যতয় ঘটেছে । কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয় আর কি ! এক শুভাকাক্ষী যিনি জানেন (বাংলাদেশ,এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং আজকে আমাদের এই সোনার বাংলা পাবার পেছনের যে কারিগর তার সর্ম্পকে আমার ভেতরে রয়েছে সীমাহীন আগ্রহ,এ সংক্রান্ত বইগুলোও পড়ি আমি দিনরাত ভুলে) তাই তিনি আমাকে বইটি উপহার দিলেন । অফিসে প্রচন্ড ব্যস্ততা আমার। আমার টেবিলে একপাশে রাখা সুদৃশ্য মলাটের বই ‘কারাগারের রোজনামচা’ । মলাটটির নিচে খয়েরি রঙের উপর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’-শেখ মুজিবুর রহমান আর উপরে আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোট্রেট । অফিসের কাজগুলো শেষ না করলেই নয় । তাই দ্রত হাত চালাচ্ছিলাম । কিন্তু ফুল কনসেনট্রেশনে কাজ করতে পারছিলাম না । বারবার চোখে পড়ছিল বইটির উপর । বইটি কখন পড়ব-কখন পড়ব মনের ভিতরে সেটাই উসখুস করছিল । সবকিছুই তো একসময় শেষ হয় । তেমনি হাতের কাজগুলোও গুছিয়ে নিলাম একসময় । হাতে নিলাম বইটি । তাকিয়ে থাকলাম বঙ্গবন্ধুর ছবিটির দিকে । এরপর প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্র্যন্ত চোখ বোলালাম । হাত বুলিয়ে দিলাম সাদা পৃষ্ঠার বইটিকে । এরপর নিজেকে বইয়ে ডোবালাম।বইটি পড়ছিলাম আর ফিরে যাচ্ছিলাম ১৯৬৬-১৯৬৮ সালে । বঙ্গবন্ধুর কারাগারে অন্তরীণ থাকার সময় নিজ হাতে সোজাসাপটা ভাবে লেখা ডায়েরি পড়ে বারবার একটি বিষয়ই অনুভব করছিলাম- যে একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিকই পারে নিজেকে শারীরিক-মানসিকভাবে কষ্ট দিয়ে, ক্ষমতাবানদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, সাজানো গোছান পরিবারের মায়া থেকে দূরে থাকতে । যা ভূঁইফোড় কোন নেতার কাছে আশা করা যায় না । নিজের জীবনকে বঙ্গবন্ধু ফুলের পাপড়ি বিছানো পথে হাঁটার জন্য তৈরি করেননি । শুধুমাত্র দেশের স্বার্থেই একদিন দুদিন নয়, বছরের পর বছর তিনি কারাবরণ করেছেন । এ বইটি নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক নিবন্ধ লেখা হয়েছে যা অনেক পাঠকের (যাদের হাতে এখনও বইটি পৌঁছায়নি) বইটি পড়ার পিছনে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র আগ্রহ। তাই আমি নিজে দুকলম না লিখে তুলে ধরতে পারি এ বইয়ে লিপিবদ্ধ চিঠির কিছু কিছু চৌম্বক অংশ :

‘তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয় । সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয় । বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত’ (২ জুন ১৯৬৬) ।

‘মতের বা পথের মিল না হতে পারে,তার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিরুদ্ধ দলের বা মতের লোককে হত্যা করতে হবে এ বড় ভয়াবহ রাস্তা । এ পাপের ফল অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে ’ ((২ জুন ১৯৬৬) ।

‘বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক বইটি পড়তে শুরু করেছি । লাগছে ভালই, বাড়িতে পড়তে সময় পাই নাই । যা হোক আওয়ামী কর্মীরা আর ছাত্র তরুণ কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে। বেপোরোয়া গ্রেপ্তারের পরেও ভেঙ্গে পড়ে নাই দেখে ভালই লাগছে । রাজনৈতিক কর্মীদের জেল খাটতে কষ্টটা হয় না যদি বাইরে অন্দোলন থাকে ।……আজাদ কাগজ দেখে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম । প্রথম লিখেছে উজির সভা হইতে জনাব ভুট্টোর পদত্যাগ আসন্ন । মোটেই আশ্চর্য হলাম না । এটাই তো স্বাভাবিক । ডিকেটটরা যখন দরকার হয় খুব ব্যবহার করে, আর যখন দরকার ফুরিয়ে যায়, ছেঁড়া কাপড়ের মত ফেলে দেয় । ছেঁড়া কাপড় তো অনেক সময় দরকারে লাগে, স্বৈরশাসকদের সে দরকারও হয় না। একদম বিদায় । টু শব্দ করার ক্ষমতা নাই’ (৪ জুন ১৯৬৬) ।

‘ আরও আটজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গায় । দমননীতি সমানে চালাইয়া যাচ্ছে সরকার।নির্য়াতনের মধ্য দিযে গণদাবী দাবাইয়া দেওয়া যায় না । গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে । ছয় দফা দাবী যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে । এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জণগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম । যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই ’(৫ জুন ১৯৬৬)

‘ আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেয়া হয় না । একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না । আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন । ভাবি শুধু সহকর্মীদের কথা ।...এদেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর । জয়ী আমরা হবই” ।……ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি । বেশ সুন্দর হয়েছে । আজকাল সকলেই প্রশংসা করে । নতুন জীবন পেয়েছে ফুলের গাছগুলি (৬ জুন ১৯৬৬)।

‘কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে । ব্যবসায়ীরা দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে । ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে । এত বড় প্রতিবাদ আর কোনদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে । ছয়দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবী -পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জণসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি ।’……‘যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল,আহত হল,গ্রেপ্তার হল,নির্য়াতন সহ্য করল তাদের প্রতি তাদের সন্তানদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি করতে পারি ! মনে মনে প্রতিঙ্গা করলাম, তাদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না,সংগ্রাম চালিয়ে যাবো । যা কপালে আছে তাই হবে’ ( ৮ জুন ১৯৬৬) ।

‘বহুদিন পর্যন্ত দুটি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করেছি । ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০/১১ টার সময় আসত,আর আম গাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেড়াত । আজ ৪০ দিন এখানে আছি কিন্তু হলদে পাখি দুটি আসল না । ওদের জন্য আমার খুব দুঃখ হল । মনে হল ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে ’……‘রাত কেটে গেছে আমার । প্রায় ৬ বছর জেল কাটিয়েছি । বোধহয় দুইহাজার রাতের কম হবে না ,বেশিও হতে পারে । আর কত রাত কাটবে কে জানে ?’(১৮ জুন ১৯৬৬)।

‘আজ আমার ৪৭ তম জন্মবার্ষিকী । এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনদিন নিজে পালন করি নাই –বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট একটি উপহার দিয়ে থাকত । মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত ।’….তখন সাড়ে ৪টা বেজে গিয়েছে । বুঝলাম আজ বোধহয় রেনু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই । পাঁচটাও বেজে গেছে । ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে । ছোট মেয়েটা আর আড়াই বছরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইযা আছে । মালাটা নিয়ে রাসেলকে পড়িয়ে দিলাম । সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল । ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে।ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম । দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠিয়েছে । রাসেলকে দিয়েই কাটলাম, আমিও হাত দিলাম । জেল গেটে সকলকে কিছু কিছু দেয়া হল । ছয়টা বেজে গিয়াছে , তাড়াতাড়ি রেনুকে ও ছেলেমেয়েকে বিদায় দিতে হল । ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম। তালা বন্ধ হয়ে গেল । ভোর বেলা খুলবে ’(১৭ মার্চ ১৯৬৭)।

‘কারাদন্ড হওয়ার পরে জেলের ভিতরে যখন আমি ফিরে এলাম । এসেই শুনলাম আমার ভিতরে আসার পূর্বেই সাধারণ কয়েদিরা খবর পেয়েছে যে আমাকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল এই জুলুমের কি কোনো প্রতিকার নাই ? এদের চোখে মুখে বেদনা ভরা । দুই একজন তো কেঁদেই দিল। আমি ওদের হাসতে হাসতে বললাম দুঃখ করবেন না । আমি তো এই পথে জেনে শুনেই এসেছি । দুঃখ তো আমার কপালে আছেই । দেশকে ও ওদেশের মানুষকে ভালোবাসলে ,কষ্ট ও জুলুম স্বীকার করতে হয় ’(২৮ এপ্রিল -৩০ এপ্রিল ১৯৬৭) ।

‘জামিন দিল না । আজ থেকে অমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি । তবে দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারের আদেশও থাকবে যদি জামিন পাই । জজকোর্টে আপিল করার পরে আবার দেশরক্ষা আইনে বিনাবিচারে জেলে থাকতে হবে । আমার পক্ষে সবই সমান । আর একটা মামলায়ও আমার জেল আছে আড়াই বছর । সেটা বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্টে পড়ে আছে । কনফার্ম করেছে এক বছর খাটতে হবে যদি হাইকোর্টে মুক্তি না পাই । বুঝতে পারলাম আরও যে ৬/৭টা বক্তৃতার মামলা আছে সব মামলাই নিচের কোর্টে আমাকে সাজা দিবে । শূধু মনে মনে বললাম ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা । বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ ( ২৩ এপ্রিল – ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭) ।

বইটি পড়ি আর একসময় আমি অনুভব করি নিজ চোখের আদ্রতা । ভাবি-এ কী করে হয় ? কীভাবে একজন রক্তমাংসের মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করে দল- নেতাকর্মী -দেশের মানুষ সর্বোপরি দেশের জন্য বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে পারেন? তার লেখা ডায়েরি আমাদের দেখিয়ে দেয় সৌম্যদর্শন বিশাল উচ্চতার মানুষটির ভেতরে থাকা একটি কোমল মন –যে মন কারাগারের একটি হলুদ পাখির জন্যও আনচান করে । যার রয়েছে মানুষ-প্রকৃতি আর প্রকৃতির নানা সৃষ্টির প্রতি গভীর ভালবাসা-তাদেরকে রক্ষার জন্য নিজের জীবনকে বাজি রাখার মত সংকল্প । সেইতো হতে পারে কেবল একটি দেশের মহানায়ক ও সে মহাকাব্য অর্থাৎ নানা ঝড়ো পথ পেরিয়ে দেশটির স্বাধীনতা আসে মহানায়কের নেতৃত্বের গুণেই ।

বইটির চমৎকার ভুমিকা লিখেছেন তারই কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । ভুমিকা থেকেই জানতে পারি ডায়েরিগুলোকে বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষণও করাটাও ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একটি চ্যালেঞ্জ । আর এই ডায়েরিও লেখা হত না যদি না বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কারাগারে রূল টানা খাতাগুলো বঙ্গবন্ধুকে সরবরাহ না করতে পারতেন ।

বইটি প্রকাশের সাথে যুক্ত সকলের ধন্যবাদ প্রাপ্য ।

মৌলি আজাদ : লেখক

(ঢাকাটাইমস/২এপ্রিল/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :