‘ফুল বৌদি’র ভাগ্যবদলের রূপকথা
বাবা-মায়ের দেয়া নাম অঞ্জুরানী সরকার। কিন্তু সেই নামে তাকে এখন খুব কম মানুষই চেনে। গোটা যশোরজুড়ে তিনি পরিচিত ‘ফুল বৌদি’ নামে। সমাজের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে দিনমজুর- সবাই তাকে চেনে একনামে। একসময় যার দিন আনতে পানতা ফুরাত, সেই নারী এখন এলাকার মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার নাম। যেন এক রূপকথার গল্প।
২০০০ সালে শূন্য হাতে পরের জমিতে ফুল চাষ দিয়ে যাত্রা শুরু অঞ্জু রানীর। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ইতিমধ্যে অর্জন করেছেন জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার। লাভ করেছেন একজন নারী উদ্যোক্তা পরিচয়।
১৫ বছরে সততা, শ্রম ও একাগ্রতার ফলে আজ অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে ‘ফুল বৌদি’। রাজধানীর বাংলা একাডেমি চত্বরে সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার ফেস্টে স্টল সাজিয়েছিলেন নিজের উৎপাদিত ফুল দিয়ে। ফুল মেলার শেষ দিন গত শনিবার (১ এপ্রিল) ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা হয় এই নারী উদ্যোক্তার।
ফুল বিক্রির টাকা জমিয়ে যশোরের কেশবপুর সদরে চার শতক জমি কিনেছেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৫ লাখ টাকা। ২০০৪ সালে এক ছেলেকে পাঠিয়েছেন কুয়েতে। ছোট ছেলে স্থানীয় কলেজে অনার্সে পড়ে। পড়াশোনার ফাঁকে সহযোগিতা করে মায়ের ব্যবসায়। নিজের ৫ বিঘাসহ ৮ বিঘা জমিতে এখন চাষ করছেন বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। বাগানের ফুল বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দিতে কিনেছেন পিকআপ ভ্যান। ছয় বছর আগে নিজের চলাফেরার জন্য কিনেছেন প্রাইভেট কার।
ফুল বৌদির ফুলচাষ ও বাজারজাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন ৮০ জন কর্মী। তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচ ছাড়াও মাসে প্রত্যেকের বেতন দিতে হয় তিন হাজার থেকে সাত হাজার টাকা। শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী এবং দরিদ্র শিক্ষার্থী।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালের ১৪ জুন ফুল বৌদির হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এম মান্নান। সিটি গ্রুপের মানবকল্যাণমুখী সংগঠন সিটি ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর নেটওয়ার্ক (সিডিএফ) যৌথভাবে এই পুরস্কার দেয়। এ ছাড়া কৃষি খাতে সাফল্যের জন্য শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিভাগে রানার আপ হয়েছেন অঞ্জু রানী সরকার।
সাদাসিধে ফূল বৌদির সব স্বপ্ন ফুল নিয়ে। নিজের এলাকাকে পরিচিত করতে চান ফুলের এলাকা হিসেবে। বলেন, ‘শুরুতে অনেকে অনেক কথা বলেছে। কিন্তু কান দেইনি। ওই সব কথা শুনলে আজকে এই জায়গায় আসতে পারতাম না।’
যেভাবে অঞ্জু রানী থেকে ফুল বৌদি
যশোরের কেশবপুর উপজেলার মূলগ্রামের বাসিন্দা অঞ্জু রানীর সংসার স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে। স্বামী সন্তোষ সরকার কৃষিকাজ করে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে কোনোমতে চলত সংসার। সংসারের নানা অভাব-অনটনের মধ্যে পথ খোঁজেন নিজে কিছু করার। সেই ভাবনা থেকে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। শুরু করেন নিজের বাড়ির আঙিনায় ফুলের চাষ। তার আগ্রহে কেশবপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানার সামনের জমি ফুল চাষের সুযোগ দেন তখনকার অঞ্জু রানীকে।
সেই থেকে এখনো চলছে। দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে ফুল ব্যবসার পরিধি। বাড়ছে পরিচিতি। দারিদ্র্য জয় করে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা।
শুরুর দিকে যশোরের অলিগলিতে হেঁটে হেঁটে বিনা পয়সায় ফুল দিতেন অঞ্জু রানী। বলতেন, ‘ফুল রেখে গেলাম। ভালো লাগলে কিছু টাকা দিয়েন, না দিলেও সমস্যা নেই।’
এভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার পরিচিতি। ফুলের প্রতি বাড়তে থাকে ওই এলাকার মানুষের আগ্রহ। এভাবেই যশোরের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অঞ্জু রানী সরকার একজন সাহসী নারী হিসেবে পরিচিতি পান। একসময় তাকে ফুল বৌদি নামে ডাকা শুরু করে মানুষ। এরপর তার আসল নামটাই যেন হারিয়ে যায়।
তবে তার সফলতাকে যতই রূপকথার মতো বলা হোক না কেন, তার যাত্রাপথের শুরুটা কিন্তু এত মসৃণ ছিল না। এলাকার অনেক মানুষের কাছে নানাভাবে বিদ্রূপের মুখে পড়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি দমে যাননি। আবার সাহায্যের হাতও পেয়েছেন অনেক। ফুল বৌদি বলেন, ‘আমার এই কাজে প্রথম ঢাকার আহসানিয়া মিশন সহযোগিতা করে। তারা সাহায্য-সহযোগিতা না করলে এত দূর আসতে পারতাম না। এখন তো অনেকে সহযোগিতা করতে চায়।’
সহযোগিতা পেয়েছেন স্বামীর কাছ থেকেও। ছোট ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি হিসাবটা দেখাশোনা করে।
দ্বিতীয়বারের মতো ফুল মেলায় এসেছেন ফুল বৌদি। শনিবার দুপুরে বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে গিয়ে তাকে দেখা যায় কয়েকজন নারীকে নিয়ে ফুল সাজাতে ব্যস্ত। কাছে গিয়ে জানতে চাই ‘কেমন আছেন?’ হাসি ছড়ায় ফুল বৌদির মুখে, ‘অনেক ভালো আছি। এবার অন্যবারের চেয়ে মেলায় মানুষ বেশি এসেছে। ফুলও বিক্রি হয়েছে বেশি।’ অকপটে জানিয়ে দিলেন নিজের ব্যবসার কথা।
কথার ফাঁকে তিনি তার ফুল বৌদি পরিচয় নিয়ে জানালেন একটি মজার ঘটনার কথা। ‘কিছুদিন আগে যশোরে নারী দিবসের অনুষ্ঠানে আমাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত করা হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক। বিশেষ অতিথি হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করা অঞ্জু রানী সরকার। তখন অনেকেই চিনতে পারছে না। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, আমাকে ফুল বৌদি নামে সবাই চিনে।’ তখন মন্ত্রীসহ সবাই হাততালি দিতে থাকেন।
ফুল বৌদির বাগানের যত ফুল
ফুল বৌদির বাগানে নানা রঙের গোলাপ, গাঁদা, বেলি, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁধা, চন্দ্রমল্লিকাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির ফুল চাষ হয়।
শুধু যশোর নয়, আরো বেশ কিছু জেলা থেকে পাইকাররা এসে তার কাছ থেকে ফুল নেন। প্রয়োজনে আড়ত থেকে নিজেই পিকআপে করে আশপাশে ফুল পৌঁছে দেন তিনি।
যে স্বপ্ন দেখেন ফুল বৌদি
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ফুলের ব্যবসা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। অনেক মানুষ আমার এখানে কাজ করবে। বিদেশেও ফুল রপ্তানি করব। প্রমাণ করব নারীরাও পারে। আমরা পিছিয়ে থাকব না।
(ঢাকাটাইমস/২এপ্রিল/মোআ)