পরাণের তন্দুরি চুলা

লেখা ও ছবি: শেখ সাইফ
| আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৫৭ | প্রকাশিত : ০৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৩:৫৫

দিন কয়েক আগে দুপুরবেলা রাজধানী ঢাকার রায়েরবাজারের ভেতর গলি পথ ধরে লোকমুখে ঠিকানা নিয়ে যাচ্ছি শ্রী শ্রী আখড়া মন্দিরের দিকে। ভেতরের গলিপথ ধরে চলতে চলতে হঠাৎ এক দোকানের দরজাভেদ করতেই চোখে পড়ল লাল গম্বুজের মতো কিছু জিনিস। দেখার আগ্রহ নিয়ে কাছে গিয়ে দেখি একজন মধ্য বয়সী ব্যক্তি গম্বুজাকৃতির গায়ে প্রলেপ দিচ্ছেন। কোথাও লাল কাঁদামাটি দিয়ে টিপে টিপে নিখুঁত সৌন্দর্য্যে পরিপাটি করছেন।

কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি ওটা তন্দুরি রুটি, বাকরখানি, নানরুটি তৈরির চুলা। যিনি কাজ করছেন তার নাম শ্রী পরাণ বাবু। দীর্ঘ ২০ থেকে ২২ বছর ধরে একাজ করে চলেছেন তিনি।

কাজ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার বাপ-দাদার আমল থেকে আদিপুরুষরা মাটির কাজ করে আসছে। বংশ পরম্পরায় আমিও এই কাজ করছি। তবে এই কাজ করার আগে আমি টেইলার্সে কাজ করতাম। যার সঙ্গে কাজ করতাম সে বিদেশ চলে যাওয়ার পর নিজেদের ঐতিহ্যের কাজে লেগে পড়ি।'

একেকটি চুলা বানাতে কতদিন লাগে জানতে চাইলে পরাণ বাবু বলেন, '১৫ দিন লেগে যায় একটা চুলা তৈরি করতে। প্রথমে সিমেন্টের গোল চাকের মতো করে তুলতে হয়। সেটা শক্ত হলে আর একটা চাক বসাতে হয় এইভাবে একটা তৈরি হয়। শক্ত করার জন্য চাকের ভেতর আগুন রেখে অল্প অল্প তাপ দেয়া হয়। এভাবেই একটি চুলা তৈরি হয়ে যায়।'

চুলা তৈরির মাটি কোথায় সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাজীপুর, টঙ্গী থেকে মাটি সংগ্রহ করি। আগে রায়ের বাজার অঞ্চলে লাল মাটি পাওয়া যেত। এখন তো সব জায়গায় বিল্ডিং হয়ে গেছে। এদিকে কোথাও এখন আর মাটি পাওয়া যায় না। তবে মাঝে মাঝে নতুন কোনো বিল্ডিং তৈরি করার সময় লাল মাটি পাওয়ার খবর পেয়ে সেখান থেকে মাটি সংগ্রহ করি।'

পরাণ বাবু জানান, এখন মাটির দাম অনেক। আবার আনতে ট্রাক ভাড়া আছে। সব মিলিয়ে ট্রাকে করে মাটি আনতে সাত থেকে আট হাজার টাকা খরচ হয়।'

চুলার দামের বিষয়ে বলেন, এক ট্রাক মাটি দিয়ে ছোট বড় মিলিয়ে আটটা চুলা তৈরি করা যায়। আকারভেদে একেকটি চুলা এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। অনেকে আগে অর্ডার দিয়ে যায়। আবার আমি নিজেও অনেক চুলা তৈরি করে রাখি।'

পরাণ বাবু বলেন, ‘চুলাগুলো শুধু দেশের ভেতরে না, বাইরের দেশেও বিক্রি হয়। আমার তৈরি চুলা আমেরিকা, সুজারল্যান্ড, কোরিয়াতেওে পাঠিয়েছি। বাংলাদেশিদের মাধ্যমে বিক্রি করেছি। তারাই বিদেশে নিয়ে গেছে।'

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই চুলা তৈরির পর অন্যসব মাটির তৈরি জিনিসপত্রের মতো পোড়ানো হয় না। রোদে শুকিয়েই কাজ করা হয়। চুলায় স্থায়িত্ব সম্পর্কে পরাণ দা বলেন, 'একটি চুলা তিন মাস ব্যবহার করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা এই চুলায় কাজ করেন তারা এক বছর পর্যন্তও ব্যবহার করেন। তারপর পরিবর্তন করেন।'

তিনি বলেন, বর্তমানে গ্যাসের চুলায় দিয়ে অনেকে তান্দুরি রুটি তৈরি করছেন। তবে বাকরখানি তৈরি করতে এই চুলা লাগে। ওই চুলায় পুড়ে যায়।

পরাণের সংসারে একছেলে আছেন। কাজ করছেন একটি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় হিসেবে। মাঝে মাঝে সেও বাবার কাজে সহযোগিতা করে। ছেলের ব্যাপারে বাবা বলেন, আমার ছেলে এই কাজ করতে চায় না। তার নিজেরও স্বাধীনতা আছে। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো এই কাজ করে যাবো। যেদিন গায়ে আর শক্তি পাবো না তখন কাজ বন্ধ করে দেব। যদি আমার ছেলে আদি পুরুষের এই পেশা ধরে রাখতে চায় তবে কাজ করবে না হলে হারিয়ে যাবে এ পেশা একদিন। পরাণের গহীন থেকেই তিনি যেন কথাগুলো বললেন।

ঢাকাটাইমস/৪এপ্রিল/এসএস/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :