বগুড়ার নবাব প্যালের দুর্লভ জয়তুন গাছ কর্তন

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
 | প্রকাশিত : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:৫৫

বগুড়াবাসীর সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে শেষ পর্যন্ত দুর্লভ জয়তুন গাছটি কেটে ফেলা হলো। জেলার নবাব প্যালেসে গাছটি দীর্ঘদিন ধরে শোভাবর্ধন করে আসছিলো। বর্তমানে দেশে এই ধরনের গাছ দুই-তিনটির বেশি নয় বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মীরা। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ঘঁনাস্থলে গেলেও তিনি বাধা দেননি। বগুড়ার বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরও বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানে না। রবিবার সকালের দিকে দিকে প্যালেসের ভেতরের পুরনো জয়তুন গাছটি কেটে ফেলার খবর ছড়িয়ে পড়লে সংবাদ কর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গাছ কাটার দৃশ্য দেখতে পান। কারা কেন দূর্লভ প্রজাতির এই গাছটি কাটছে তা’ জানতে চাইলে প্যালেসের ম্যানেজার দাবিদার জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘এটা একটা ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি। বগুড়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান মিলন, আব্দুল গফুর ও শফিকুল হাসান জুয়েল ক্রয়সুত্রে এই প্যালেসের মালিক। আমি তাদের নিয়োজিত ম্যানেজার হিসেবে গাছ কাটার অর্ডার দিয়েছি।

সরকারি গেজেট অনুযায়ী প্যালেসটি সংরক্ষিত বলে ঘোষিত হওয়ায় গাছ কাটার খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একজন ফিল্ড ইন্সপেক্টর হাসিবুল হাসান প্যালেসের ভেতরে যান। তার সামনেই গাছ কাটা চলতে থাকলেও তিনি তা বন্ধ করার চেষ্টা করেননি। গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘বনবিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া এই গাছ কাটার কোন সুযোগই নেই।’ তারপরও আমি যা দেখলাম, তার লিখিত বিবরণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবো। বাকিটা কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, গাছ কাটার বিষয়টি তাকে কেউ জানায়নি। তিনি পরে অন্য একটি গণমাধ্যমের কর্মীকে বলেন, ‘প্যালেসের সুরক্ষার জন্য জয়তুন গাছের দুই একটি ডাল কাটা জরুরি হয়ে পড়েছে তাই শুধুমাত্র ডাল কাটার মৌখিক অনুমতি দিয়েছি, গাছ কাটার নয়।’

বগুড়া সদর সার্কেল রেঞ্জার তোজাম্মেল হক জানান, গাছ কাটার বিষয়টি তাদের কেউ জানাননি। তিনি আরো জানান জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে চিঠি দিলে তারা কেবল মূল্য নির্দারণের বিষয়টি দেখেন।

স্থাপনা ঐতিহাসিক

বৃটিশ আমলে নীলকুঠি হিসেবে নির্মিত দুই শতাধিক বছর বয়সী এই প্যালেসটি নিলামে কিনে নেন বগুড়ার নবাব আব্দুস সোবহান চৌধুরী। ১৮৯২ সালে আব্দুস সোবহান চৌধুরীকে নবাব খেতাব দেওয়ার উপলক্ষ্যে নিজ হাতে গাছটি রোপন করেন তৎকালীন বাংলার ছোট লাট চার্লস ইলিয়ট।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) এই প্যালেসেরই মোতয়াল্লি ছিলেন। তার অবর্তমানে ওয়াকফ এ লিল্লাহকৃত এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি তার বৈমাত্রীয় ভাই ওমর আলী চৌধুরী এবং দুই পুত্র সৈয়দ হাম্মাদ আলী ও হামদে আলী বেআইনি প্রক্রিয়ায় এটি দফায় দফায় বিক্রি করে দেন।

বগুড়া শহরের সূত্রাপুর মৌজার ১৭০৮ নং দাগে অবস্থিত নবাবাড়ির মোট সম্পত্তির পরিমাণ তিন একর ৭৫ শতক বা প্রায় ১০ বিঘা। এর বেশিরভাগ আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এই সম্পত্তির উপর ক্রেতারা গড়ে তুলেছেন আল আমিন কমপ্লেক্স টিএমএসএস মহিলা মার্কেট, শরীফ উদ্দিন সুপার মার্কেট ও বহুতল বাণিজ্যিক ভবন রানার প্লাজা।

২০১৬ সালের এপ্রিলে সরকারি মূল্য হিসেবে স্থাপনাসহ বাড়ি বিক্রি হয়েছিল ২৭ কোটি ৪৫ লাখ ৭ হাজার টাকায়। এটা কিনেছিলেন যৌথভাবে বগুড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের ছেলে ও বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি মাছুদুর রহমান মিলন, ব্যবসায়ী শফিকুল হাসান জুয়েল ও আব্দুল গফুর। প্রয়াত নেতা মোহাম্মাদ আলীর দুই ছেলে সৈয়দ হামদে আলী চৌধুরী ও সৈয়দ হাম্মাদ আলী চৌধুরী দলিলে সই করেছেন এবং ১৭ এপ্রিল দলিল রেজিস্ট্র্রি (দলিল নং -৪৩১৮) হয়।

এই বাড়ি বিক্রির প্রতিবাদে সোচ্চার হয় বগুড়াবাসী। চলতে থাকে আন্দোলন। পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে বিক্রি হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহি নবাববাড়িটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব ছানিয়া আক্তার স্বাক্ষরিত এসংক্রান্ত একটি চিঠি বগুড়া জেলা প্রশাসকের কাছে পৌঁছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব বাড়ির (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধুরীরর স্মৃতি বিজরিত বাড়ি) ঐতিহাসিক ও প্রতœতাত্বিক গুরুত্ব থাকায় ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইন (১৯৭৬ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় সরকার উল্লেখিত বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব বাড়িটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে বর্ণিত পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণ বিজ্ঞপ্তি জারি ও পরবর্তী গেজেটে তা প্রকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ঢাকাটাইমস/০৯এপ্রিল/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :