ধ্বংস হচ্ছে ভাওয়াল গড়
গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় পরিবেশ বিদ, ভূগোলবিদ, শিল্পী, ভাবুক, লেখক ও গবেষকসহ ভ্রমণপ্রিয় দেশি-বিদেশি মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গরাজ্য হিসেবে সুবিবেচিত। এর নিসর্গ ও অবকাশ যাপনের অনুকূল পরিবেশ পর্যটকদের সহজেই কাছে টানে। মুগ্ধ করে ছায়া সুনিবিড় বনপথ। অথচ নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, ভ্রমণপ্রিয় সৌন্দর্য পিপাসু ও নিসর্গপ্রেমী মানুষের বিপুল পদচারণায় ভাওয়াল গড়ের বনাঞ্চলে বহু পিকনিক স্পট, স্যুটিং স্পট, বাগান বাড়ি, খামার বাড়ি, অবকাশ যাপনের নিরিবিলি কটেজ, রেস্তোরাঁ, হাওয়া পরিবর্তনের জন্য বিস্তর ব্যবস্থা ও পরিবেশ গড়ে উঠলেও সুন্দর বনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুপ্রাচীন কালের বিশাল গজারি বনের সাম্রাজ্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাঘের বাজার বাস স্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে রাথুরা বিটে গড়ে তুলা হয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ সাফারি পার্ক। রাজেন্দ্রপুরে ভাওয়াল গড়ের আড়াইশ প্রসাদ মৌজায় বন বিভাগ ও সরকার কর্তৃক এখানে গড়ে উঠেছে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানসহ প্রায় দেড় শতাধিক স্পট ও রিসর্ট পয়েন্ট থাকা সত্ত্বে ও পর্যটন শিল্পের বৃহৎ ক্ষেত্র ভাওয়ালের গড় রাঘব বোয়ালদের জবর দখল, গ্রাস ও দূষণের ফলে আজ মারাত্মক বিপর্যয় ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে আড়াইশ প্রসাদ মৌজায় ঘন গজারি বনবেষ্টিত পরিবেশে গড়ে উঠেছে ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক। ৬টি প্রবেশ ও নির্গমন পথের এক পাশে প্রাচীর ঘেরা এ সমৃদ্ধ উদ্যানে অবকাশ, অবসর, চম্পা, শাপলা ও আনন্দ এলাকা শিরোনামে বেশকিছু স্পটসহ উদ্যানের ভেতরে পিকনিক, স্যুটিং ও অবকাশ যাপনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। রয়েছে শাপলা, শালুকে ভরা ঝিল ও কাজল কালো জলের সুবিশাল দিঘী।
ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কের পাশে বি.কে বাড়ি মৌজায় রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা বেশ কিছু বাগান বাড়ি ও স্পট। এখানে আছে স্যুটিং ও পিকনিক স্পট। পাশের বাহাদুরপুর মৌজায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের একমাত্র রোভার স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
হোতাপাড়ায় গড়ে উঠেছে খতিব খামার বাড়ি, শ্যামলীর মতো নান্দনিকতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া চলচ্চিত্র স্যুটিং স্পট। নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ একান্তে লালিত তার স্বপ্ন ও আকাঙ্খার সমান বড় করে পিরুজালী মৌজার রাথুরা বিটে গড়ে তুলেছেন নুহাশ পল্লী। তার পাশেই তরুবীথি, তপোবন। মাহনা ভবানীপুরের পিঙ্গাইলে শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গ্রীণটেক রিসোর্ট এ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার। এরকম আরো অনেক রিসোর্ড।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গছে, গাজীপুরে ৯৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান জবর দখল করে আছে ২৩৮.৫১ একর বনভূমি। পারটেক্স গ্রুপ, ইভিন্স গ্রুপ, জেসন এগ্রোভেট লি., সান পাওয়ার সিরামিকস লি., ফার সিরামিকস লি., রাজেন্দ্র ইকো রিসোর্টের মতো ৯৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভাওয়াল গড়কে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী বলেন, ‘ভাওয়ালের গড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বা ধ্বংস হচ্ছে এরকমটি আমি মনে করি না।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেখানেই জবর-দখল বা অসঙ্গতির খবর পাচ্ছি- তাৎক্ষণিক সরেজমিনে যাচ্ছি ও অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি।
বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক বনবিভাগের সম্পত্তি দখল ও তা উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী বলেন, আমরা অভিযুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছি।
এ ব্যাপারে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস.এম. আলম বলেন, আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। আমার মেরুদণ্ড সোজা। বনবিভাগ থেকে সুষ্পষ্ট প্রপোজাল পেলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক জমি উচ্ছেদে যা করা লাগে সবই করব। সেক্ষেত্রে কোনো অনৈতিক চাপ আমাকে টলাতে পারবে না।
বন সংরক্ষক মো. সাহাবউদ্দিন ভাওয়ালের গড়ের ধ্বংসযজ্ঞে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, বনের ভেতরে এখানে ওখানে থাকা ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি পাবলিককে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকার এ সকল সম্পত্তি অধিভুক্ত করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করলে পরিবেশ, বন ও ভূমির বিপর্যয় অনেকটা ঠেকানো যাবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ.এস.এম. জহির উদ্দিন আকন ঢাকাটাইমসকে বলেন, বন বিভাগে একটি বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। প্রান্তিক মানুষকে আমরা সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে একীভূত করতে পেরেছি। মানুষ এখন অসচেতন নন। জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা তাদের নানা সভা সেমিনারের মাধ্যমে ধারনা দিচ্ছি। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বন ও প্রকৃতি কতোটা জরুরি তা ও বুঝাচ্ছি। সাড়াও পাচ্ছি। একটা পরিবর্তন এসেছে।
সার্বিক বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, এখানে আমাদের ব্যর্থতা আছে। আমাদের সম্পত্তি দস্যুরা নিয়ে যায় আমরা তা রক্ষা করতে পারি না এর দায়ভার তো আমরা এড়াতে পারি না। তবে রাজনৈতিক নেতারা সার্বিক বিবেচনায় তুলনামূলক কম দায়ী।
তিনি বলেন, এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা ও বন বিভাগের উদাসীনতা দায়ী। অনেক সময় এমনও হয় ভূমিদস্যুরা ট্যাম্পারিং কাগজ করে সম্পত্তি দখল করার ফলশ্রুতিতে তা মামলায় গড়ালো, বন বিভাগের কর্মকর্তারা আর্থিক প্রলোভনে তখন আর প্রয়োজনীয় কাগজপ্রত্র আদালতে উপস্থাপন করে কনটেস্ট করেন না। অনেকটা দায়সারা ভাবে তারা দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ভূমিদস্যুরা একতরফা রায় পেয়ে যায়।
মন্ত্রী বলেন, সদিচ্ছা থাকলে ও এ্যাকশনে যেতে চাইলে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে প্রয়োজনে বারবার যোগাযোগ রক্ষা ও তাগাদা দিয়ে পদক্ষেপে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
তিনি বলেন, বন রক্ষায় বনের আইন নতুন করে সংশোধন করা হয়েছে। সরকারি সম্পত্তিতে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত কল-কারখানা উচ্ছেদে আগেও আইন ছিল। তবে এবার নতুন করে আমাদের সরকার অধিকতর কঠিন আইন প্রনয়ণ করেছে। এখন সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ হলে এবং তা বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বন ভূমি সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখলে আশা করছি সুফল আসবে।
(ঢাকাটাইমস/৯এপ্রিল/আঞ্চলিক প্রতিনিধি/এলএ)
মন্তব্য করুন