গণপরিবহনে নারীর কষ্ট লাঘবে আইন, মানবে কি পুরুষযাত্রী?

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:০৯

আউয়াল খাঁন, ঢাকাটাইমস

নৈরাজ্যে ঠাসা ঢাকার গণপরিবহন নারীযাত্রীর জন্য যেন কয়েকগুণ বেশি কষ্ট আর বিড়ম্বনার কারণ। পুরুষযাত্রী যদিও দাঁড়িয়ে, ঝুলে, গায়ে গা লাগিয়ে ঘামে ভিজে কোনোমতে আসা যাওয়া করেন, নারী যাত্রীদের জন্য সঙ্গত কারণেই এভাবে যাতায়াত আরও বেশি বিড়ম্বনার। নারীযাত্রীদের কষ্ট-বিড়ম্বনা কমাতে তাই সরকার উদ্যোগ নিয়েছে কঠিন কিছু আইনের মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণের।

কিন্তু নারী যাত্রীদের অশেষ কষ্ট শেয়ার করে নিতে কতটুকু প্রস্তুত পুরুষযাত্রীরা? আইনের প্রতিই কতটুকু শ্রদ্ধা থাকবে পুরুষ যাত্রীদের? নগরীর নানা পাবলিক বাসে ঘুরে দেখা গেছে, আইন প্রণয়ন হওয়ার আগেই যেন আইন ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিয়েছে পুরুষ যাত্রীদের একাংশ।  
বাস সার্ভিসগুলো নারী, শিশু ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য ৯টি আসন রেখে দিলেও পুরুষ যাত্রীদের একাংশের অসহযোগিতায়, এমনকি আগ্রাসি আচরণে এর সুফল পাচ্ছেনা নারীযাত্রীরা। তবে সব পুরুষযাত্রী একরকম নয়। কেউ সিট ফাঁকা রেখে দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউ নারীযাত্রী বাসে উঠলে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান। কিন্তু পুরুষযাত্রীদের একাংশের আচরণ সমস্ত ভব্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।    

যেমন ইন্টারসিটি বাসে নারীদের আসনে বসে এক পুরুষযাত্রী সোমবার কী বলছিলেন দেখুন। নারী যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে, অন্যান্য পুরুষযাত্রীরা তাকে বারবার অনুরোধ করছেন। কিন্তু পুরুষ যাত্রীর সেদিকে খেয়াল নেই। একপর্যায়ে মারমুখো হলেন, ঝগড়া শুরু করলেন তিনি। উচ্চস্বরে বলতে থাকলেন, ‘নারীরা আমগো সিডে বসে হেইডা কিসু না? মন্ত্রিসভায় মাত্র তো অনুমোদন দিসে। দেহেন আইনডা পাস অয়নি। আর যদিও আইন পাসও অয়, তাইলে কয়দিন এই আইন টিকে হেইডা দেইখেন। এইডা বাংলাদেশ।’

শুধু এই ভদ্রলোকই নন, পরশু ফার্মগেটে ইটিসি পরিবহনে, মার্চের ২৮ তারিখ বুধবার সকালে যাত্রাবাড়িতে তুরাগ পরিবহনেও দেখা যায় পুরুষ যাত্রী নারীদের আসন দখল করে বসে আছে।

নারী যাত্রীরা তাদের উঠে জায়গা দিতে বললে, তাহলে কর্কশ কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘নারী পুরুষ সমান অধিকার- নারীরাও তো আমাদের সিটে বসে, আমিও নারীদের সিটে বসছি বা আগে বসছি ওঠতে পারবনা বা আমার ওয়াইফ (স্ত্রী) অসুস্থ সাথে থাকতে হবে ইত্যাদি।

ঢাকার প্রতিদিনের দৃশ্য এগুলো। অনেকে মুখে লুপ এটে বসে থাকেন। আবার কেউবা মহিলাদের সাথে অকথ্য ভাষায় ঝগড়া করেন। সম্মানহানীর ভয়ে অনেক মহিলা চুপ মেরে যান। কেউবা প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরো কয়েকটা অশ্রাব্য শব্দ শুনেন। এ রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি দেখে সংরক্ষিত আসনের বাইরে অনেক পুরুষ হয়তো নিজের আসনটি নারীদের সম্মানে ছেড়ে দেন। যদি কেউ সহযোগিতা না করেন, তাহলে বাকি পথটুকু কোনোমতে দাঁড়িয়ে যেতে হয় তাদের।

বাসের হেল্পার, কন্ডাকটররা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নারী যাত্রীদের সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে সহযোগিতামূলক আচরণ করেন। কিন্তু পুরুষ যাত্রীদের একাংশের মারমুখী আচরণে হার মানতে হয় তাদেরও। সু-প্রভাত পরিবহণের চালক উজ্জল ও হেল্পার সুমন, ইন্টার সিটির চালক রানা, ইটিসির হেল্পার রাকিবসহ একাধিক গাড়ির চালক, হেল্পার ও বাস মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গাড়িতে উঠে মহিলা আসনে বসতে নিষেধ করার পর যারা বসে, মহিলা, শিশু বা প্রতিবন্ধী উঠলে সেই আসন ছেড়ে দিতে হবে এমন শর্ত জুড়ে দেয় চালক বা হেল্পার। তারপরও এ শ্রেণির ‘ভদ্রলোকেরা’ অনেকটা গায়ের জোরেই নারীদের আসন দখল করে বসে থাকে বলে জানান তারা।

সাংবাদিক বিলকিছ ইরানী, শিক্ষিকা আনজুম আরা, মেডিকেল শিক্ষার্থী আরিফা আক্তার অনি, ব্যবসায়ি মেহের খানমসহ একাধিক নারীর অভিযোগ প্রায় একইরকম। সাংবাদিক বিলকিছ ইরানি জানালেন ‘অনেক পুরুষ বলেন আমরা নারীরা নাকি বাসে উঠেই সমঅধিকার দাবি করি। আবার বলে, আপনারা আমাদের আসনে বসেন সেটা কিছুনা? যদি তাই হতো, তাহলে গাড়িতে চল্লিশটা আসনের মধ্যে মাত্র নয়টা আসন আমাদের জন্য কেন বরাদ্দ? ২০ টা আপনারা নিন আর বাকি ২০ আসন আমাদের দিন। আমরা আপনাদের আসনের ধারে কাছেও যাবনা। অনেক সময় সংরক্ষিত আসনে এই ভদ্রলোকেরা বসে থাকে, আমরা বাসে উঠতে গেলে আবার তারাই সিট খালি নাই বলে হেল্পারদের নির্দেশ দেয় আমাদের নামিয়ে দিতে। হেল্পাররাও অনেকসময় ঝামেলা এড়াতে আমাদের বাসে তুলতে চায়না। বলে দেয় সিট খালি নাই!’

আরেকজন নারী ভুক্তভোগী বললেন, ‘বাসের সব আসন আপনাদেরই থাকুক। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত নয়টা আসনেই আমাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু আপনাদের থেকে আশা করি। নোংরা ভাষা ব্যবহার করে আমাদের অপমান করবেন না। আপনারা আমাদের জন্য কোন আসন রাখেননি বিধায় সরকার মাত্র নয়টা আসন আমাদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। তাও এই নয়টা আসনে শিশু ও প্রতিবন্ধীরও অংশ আছে। আমরা আপনাদের সাথে ধস্তাধস্তি করে গাড়িতে চড়ার ক্ষমতা রাখিনা।’

ঢাকা ট্রাফিক উত্তরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পরিবহনে নারীদের অবশ্যই তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। নারী, শিশু বা প্রতিবন্ধিদের আসনে যদি কোন পুরুষ বসে থাকে, তবে আমার অনুরোধ থাকবে কাছের কোন ট্রাফিক পুলিশ বক্সে গিয়ে ভুক্তভোগী সেই নারী যেন এ বিষয়ে অভিযোগ করে।  তাহলেই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আইনী ব্যবস্থা নিব’। এ ক্ষেত্রে পরিবহনের সুপারভাইজার বা হেল্পার এবং সংশ্লিষ্টযাত্রীকে শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মফিজুর রহমান বলেন, ‘মন্ত্রীসভায় সংরক্ষিত আসন নিয়ে যে খসড়া অনুমোদন দেয় হয়েছে, সেটা যদি যদি আইন হয়ে আমাদের কাছে আসে, তখন আমরা এই ধরনের  লোকদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নিব।’  

(ঢাকাটাইমস/ ১১ এপ্রিল/এএকে/এসএএফ/ )