হেফাজতের আচরণ সাপের মতো : অধ্যাপক নিসার হোসেন
পয়লা বৈশাখ। বাঙালির বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন। ভোর থেকে এদিন বাঙালি জাতি মেতে উঠবে বর্ষবরণের উৎসবে। আর সেই উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এবার নতুন আবহে বের করা হবে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা। সারা দেশেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করা হবে অমঙ্গল তাড়ানোর প্রতীকী এই আনন্দযজ্ঞ।
এবার অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে শোভাযাত্রা হবে আরো বেশি তাৎপর্যময়। কেননা এবারই এই আয়োজন পেয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। তাই এবার বিশাল পরিসরে শোভাযাত্রাটি হবে আরো বেশি রূপময়, আরো বেশি বর্ণিল।
সব মিলিয়ে বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরে হচ্ছে এবারের আয়োজন। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে এই সময়কে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা উপকমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নিসার হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাইফ।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবারের প্রতিপাদ্য কি? অসুন্দরের বিরুদ্ধে, অমঙ্গলের বিরুদ্ধে এবার শোভাযাত্রার মূল থিম ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।’ আমরা সবার কাছে প্রতিবার একটি বাণী পৌঁছে দেই। তা থেকে যেন মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। হৃদয়ে যেন সুন্দর একটি আনন্দের পরিবর্তন ঘটে। আমাদের কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, আচার অনুষ্ঠান আছে, যা সব ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের মানুষের। সবাই যেন অংশগ্রহণ করতে পারে সে সব আচার অনুষ্ঠানে। যেমনÑ নবান্ন উৎসব, পয়লা বৈশাখ, নৌকা বাইচ, মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রভৃতি। সুতরাং যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করছে সেখানে ভিন্নমনার কিছু মানুষের উপস্থিতি থাকতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। যেমন দুই বছর আগের পয়লা বৈশাখে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। যদিও গত বছর তেমন কিছুই ঘটেনি। সুতরাং স্লোগানটা কি বলছে সেটা যেন মানুষ বুঝতে পারে। মূলত এই বাণীটিই আমরা পৌঁছে দিতে চাই।
এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু এবং শেষ হবে কয়টায়? প্রতিবছরের মতো এবারও ৯টায় শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে আপনি জানেন, এবার কিন্তু অন্য মাত্রায় এটি পালিত হবে। এবার অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে শোভাযাত্রা হবে আরো বেশি তাৎপর্যময়। কেননা এবারই এই আয়োজন পেয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। তাই এবার বিশাল পরিসরে শোভাযাত্রাটি হবে আরো বেশি রূপময়, আরো বেশি বর্ণিল। সব মিলিয়ে বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরে হচ্ছে এবারের আয়োজন। আর গণমাধ্যম এটা নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহের সঙ্গে কাজ করছে, আমি দেখছি। সুতরাং ৯টায় শুরু হলেও আগের মতো দেড় ঘণ্টায় শেষ করে ফিরে আসা সম্ভব হবে না মনে হচ্ছে। এবার শোভাযাত্রা শুরু হয়ে ফিরে আসতে ১১টা বেজে যাবে আশা করছি।
কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? হ্যাঁ, হেফাজতে ইসলাম মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে কাজ করছে। আসলে তাদের চিন্তা-চেতনা কেমন শুনুন। সাপের আচরণের মতো। তবে উল্টাভাবে কাজ করছে তারা। হেফাজতে ইসলাম প্রথমে লেজ ঢুকায় তারপর সুবিধা মতো মাথা বের করে। তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়ে কিছু বলবে না। কিন্তু স্বাধীনতার কাজকর্মের সব কিছু তারা ধূলিসাৎ করে দিতে চায়। নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় শেষ স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত।
মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তা নিয়ে জানতে চাই। গত বছর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী খুব জোর দিয়ে কাজ করছে। যার দরুন কিন্তু কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটিতে আমরা যারা আছি তারা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন সব ধরনের সহযোগিতা করার। আর এবার যেহেতু অনেক মানুষের সমাগম হবে ধারণা করা হচ্ছে সুতরাং নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশাসন অধিক গুরুত্ব দিবে। আর আমরা অতিরিক্ত অনেক জায়গায় সিসি ক্যামেরা লাগাচ্ছি। যাতে করে সব দিক থেকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এবার ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটি কীভাবে দেখছেন? এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতির জন্য এক বড় অর্জন। আমরা ১৯৮৯ সালে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করি। তারপর ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে। ইউনেস্কো আমাদের সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছে এতদিন। তারপর ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। তারা বিশ্বের সংস্কৃতির তালিকায় আমাদের সংস্কৃতিকে যুক্ত করেছে। এটা ‘হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি।’ এটা আমাদের দেশের সরকার কতটুকু উপলব্ধি করতে পারছে আমি ঠিক জানি না বা আমরা শিক্ষকরা মনে হয় এখনো এ বিষয়ের গুরুত্বটা ঠিক সেভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন এটি নিয়ে আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে সবার অংশগ্রহণের কারণে মূলত। সামনে আরো বড় পরিসরে আরো ভালো করে কাজ করতে হবে আমাদের।
ঢাকাকেন্দ্রিক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সারা দেশে কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়? বিশ্ব ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রাটি প্রথম যাত্রা করে ১৯৮৯ সালে। প্রথম বছরেই নববর্ষ উৎসব উদযাপনকারীদের নজর কেড়ে নেয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। এর পর থেকে এটা বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম শুরু করে এটি। একটি কথা নিশ্চয় আপনি জানেন, সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করছে। তারা বিভিন্ন জেলা থেকে আগত।
শিক্ষার্থীরা কিন্তু নিজ অঞ্চলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করে থাকে। নিজেদের অঞ্চলে নিজেরাই নিয়ে গেছে এ উৎসবকে। রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল এমন আরো কয়েকটি জেলায় বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেগুলো কিন্তু শিক্ষার্থীরাই তৈরি করেছে। আর আমাদের মাঝে শুরু থেকেই এই চিন্তা-চেতনা ছিল।
এখন সরকারিভাবে প্রতিটি জেলার শিল্পকলা একাডেমি থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার জন্য সরকার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া আমি জেনেছি স্কুল পর্যায়ের কয়েকটি সংগঠনও মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। সামনে এটা পয়লা বৈশাখের মতো সর্বজনীন হয়ে সারা দেশে পালিত হবে।
আর একটা বিষয়। উৎসব দুই ধরনের হয়। একটা ধর্মীয় অনুভূতির আর একটা সর্বজনীন। একটা নিছক ইহলৌকিক আনন্দ, মঙ্গল ও কল্যাণের। অন্যটি পারলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। যেমন ধরুন- পূজা ও ঈদের কথা বলি। এখানে কিন্তু মুসলিম ও হিন্দুধর্মের বিষয়টি জড়িত। এখানে পারলৌকিক মুক্তি, কল্যাণের বিষয়টি জড়িত। এক ধর্মের মানুষ বিশেষ করে পালন করবে অন্য ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ নাও করতে পারে। এখানে একটি পরিসীমার মধ্য থেকে আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হয়।
ধর্মীয় বিষয়গুলোতে মন খুলে আনন্দ করা যায় না। কিন্তু পয়লা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নৌকা বাইচ, নবান্ন উৎসব, মেলা প্রভৃতি সবাই একাত্ম হয়ে অংশগ্রহণ করে। এখানে কোনো পারলৌকিক বিষয় নেই। এখানে সবার সঙ্গে সবাই আনন্দ করে। কোনো পরিসীমা কাজ করে না। এখানে সবাই আনন্দ করে, সবার মঙ্গল কামনা করে, সুন্দর জীবনযাপনে মিশে যায়। যারা এমন আনন্দের পরিবেশ তৈরি করে তারাই প্রকৃত সুখী জীবনযাপন করে এবং সমৃদ্ধ জাতি। বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা সেটাই দেখতে পাই।
মন্তব্য করুন