বাংলা নববর্ষ

প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৭:৩৪

জুলফিয়া ইসলাম

প্রাকৃতিক পরিবর্তন প্রকৃতির রাজ্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এর প্রভাব প্রকৃতির প্রতিটি অঙ্গে ফুটে ওঠে। হোক তা মানুষ কিংবা অন্য কোনো প্রাণী। শরীর ও মনে আসে উদ্দীপনা। মনের উদ্দীপনার প্রকাশ হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে। এসব অনুষ্ঠান সর্বত্র এক নয়। যুগে যুগে, দেশে দেশে মানুষের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী এর বিবর্তন ঘটে।

নববর্ষের উৎসব প্রায় চার হাজার বছর পূর্ব থেকে প্রচলিত। চার হাজার বছর পূর্বেও প্রাচীন এই উৎসব পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর সব দেশেই নববর্ষ পালন করা হয়। দিনটি নির্ধারিত হয় বছরের প্রথম দিনে। মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ শুরু হয় নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যাবিলনীয় নববর্ষ হতো মহাবিষুব দিনে ২০ মার্চ এবং আসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষুব দিনে ১১ সেপ্টেম্বর। ওই দিনে মিশর, তিউনিশিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত গ্রিকদের নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং পরে তা ১ জানুয়ারিতে।

বাংলা নববর্ষ এদেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখের উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে এদেশের নর-নারী এই ঐতিহ্যকে লালন করছে। বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবর চালু করেছিলেন। এর সঙ্গে উৎসব জড়িত থাকলেও উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতি। কারণ বছরের এই দিনে রাজস্ব আদায় করা হতো।

মূলত পৃথিবীর যেকোনো জাতীয় উৎসবের রূপ তার আচরিত অনুষ্ঠানগুলোতেই ধরা পড়ে। বাংলা নববর্ষের জন্য এ কোনো বিশিষ্ট ব্যবস্থা নয়। পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ গ্রীষ্মঋতুর আগমনের তথা সারা বৈশাখ মাসের বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তচাঞ্চল্যের বহুমুখী অভিব্যক্তি বড়-ছোট নানা অনুষ্ঠানে রূপ গ্রহণ করে থাকে। তাই নববর্ষের তাৎপর্য বুঝতে হলে এ দিনের অনুষ্ঠানগুলোর ওপর আলোকপাত করতে হবে।

পয়লা বৈশাখ বাঙালিকে নতুন প্রাণে উজ্জীবিত করে। সেদিন সবাই নতুন অথবা ভালো পোশাক পরে ঘরের বাইরে আসে। তার সব কর্মে আনন্দ মিশে থাকে। আহারের আয়োজনেও বাঙালি উৎসব চলে। শিশুরা কোলাহল-মুখর হয়। মুখে বাজে বাঁশি। ঘরে ঘরে বাংলার ঐতিহ্য ইলিশ মাছ ভাজা অপরিহার্য থাকে। একসময়ের বাংলার সাধারণ মানুষের আহার উৎসবের সংস্কৃতি স্মরণ করে ইলিশ মাছ, কাঁচা আমের ভর্তা, পায়েস ফিরনি, পিঠা পুলি ইত্যাদির আয়োজন করে আধুনিক বাঙালিরা উৎসব করে। একসময় বাংলায় যেটা নিত্য ছিল আজ সেটা উৎসবের আমেজ আনে।

বাংলা নববর্ষের আরেকটি অনুষ্ঠান ‘পুণ্যাহ।’ এই শব্দটির মানে হচ্ছে পুণ্য কাজ করার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে পুণ্য দিন। অথচ বাংলায় এর অর্থ বিকৃত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেÑ জমিদার কর্তৃক গরিব প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা। অর্থাৎ নতুন বছরের খাজনা আদায়ের প্রারম্ভিক দিন। পয়লা বৈশাখ ছাড়াও এই পুণ্যাহ সারা মাস ধরে পূর্ব নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠিত হতো। জমিদার তালুকদাররা পান-সুপারি দিতেন এবং কোথাও মিষ্টি বিতরণও করতেন। প্রজারা নতুন জামাকাপড় পরে মিষ্টিমুখ করত। ওই দিন জমিদার আর প্রজার দূরত্ব কমে আসত। তারা পরস্পর মিলিত হতো এবং পরস্পরের সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনা করত।

জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার এবং অন্যান্য রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিদের একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হতো। এ অনুষ্ঠানে আগের বছরের রাজস্ব পরিশোধ করা হতো এবং নতুনভাবে বন্দোবস্ত নেওয়া হতো। এ অনুষ্ঠানে নওয়াব দরবার পরিচালনা করতেন এবং যে সব ব্যক্তি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারতেন তাদের তিনি সম্মানসূচক খিলাত বা পোশাক পরিয়ে দিতেন। এভাবে জমিদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীও তাদের প্রজাদের নিয়ে এ অনুষ্ঠান পালন করতেন। প্রজারা বিগত বছরের রাজস্ব পরিশোধ করতেন এবং নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। তারা জমিদারের কাচারিতে একত্রিত হতেন এবং নায়েবের কাছ থেকে পান-সুপারি গ্রহণ করতেন। এ উপলক্ষে নাচ, গান, যাত্রা, মেলা, গবাদিপশুর দৌড়, মোরগ লড়াইসহ আরো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান পালিত হতো। মোগল আমলে এ পুণ্যাহর নির্দিষ্ট কোনো তারিখ ছিল না। ফসল তোলার সময় এটার তারিখ নির্ধারিত হতো। মুর্শিদকুলি খানের নতুন রীতি হলো, চৈত্র মাসে অর্থাৎ বাংলা সনের শেষ মাসে মার্চ-এপ্রিলের দিকে ফসল তোলা শেষ হওয়ার পর পুণ্যাহ উৎসব শুরু হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল কম হলে পুণ্যাহ উৎসবেই রাজস্ব মওকুফের সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। পুণ্যাহ মানে সব রাজস্ব নয়। অন্যায়ভাবে আদায়কৃত রাজস্ব মওকুফ কিংবা স্থগিত করা হতো। চাষিদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা ছিল এবং ঋণের লেনদেন এই উৎসবেই সম্পন্ন হতো।

ঐতিহাসিকভাবে দুই ধরনের পুণ্যাহ ছিল। সদর এবং মফস্বল। সদর পুণ্যাহে জমিদার এবং অন্য ভূস্বামীগণ বাংলার দেওয়ানের বাসভবনে অংশগ্রহণ করতেন। মফস্বল পুণ্যাহ উৎসব জমিদারের কাচারিতে অনুষ্ঠিত হতো। খাস প্রজাদের মধ্যে এ উৎসব বিদ্যমান ছিল। এ রীতি চালু হয়েছিল যেভাবে, সেটা হলো খাসজমির বন্দোবস্ত ছিল না বিধায় কিছু জমি শর্তমাফিক ইজারাদারদের দেওয়া হতো। এসব খাসজমির   বন্দোবস্তের জন্য জোতদার ও ইজারাদারদের নিয়ে পুণ্যাহ উৎসব হতো এবং এটা হতো কালেক্টরদের অফিসে। জমিদার আর প্রজাদের মধ্যে যাতে স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে এজন্য এ উৎসব পালিত হতো। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১ তারিখে এটা নিয়মিত উৎসবে পরিণত হয়। মেলারও প্রবর্তন হয়। ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত হলে পরে এ উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নববর্ষ উদযাপনের কিছু অনুষ্ঠানাদি মেলা, নৌকাবাইচ, পুতুল নাচ এসব রয়ে যায়।

বাংলার রাজস্ব আদায়-সংক্রান্ত বার্ষিক বন্দোবস্তের একটা উৎসব। জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর পুণ্যাহ উৎসবেরও বিলুপ্তি ঘটে।
এ রকম বাংলা নববর্ষের উৎসব অনেক। নববর্ষের আর একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে হালখাতা উৎসব। যারা ব্যবসায়ের হিসাব রাখেন তাদের মধ্যেই এই অনুষ্ঠানটি প্রচলিত। ব্যবসায়ীদের বিপণিগুলো পয়লা বৈশাখে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এদিনে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বেচাকেনার চেয়ে আলাপ-আলোচনা বেশি চলে। হালখাতায় বাংলা নতুন বছরের হিসাব টুকে রাখার জন্য নতুন খাতা খোলা হয়। যারা নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থী তাদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এই দিনে কেউ বাকি দিতে চায় না। এই হালখাতা ও পুণ্যাহ অনুষ্ঠান ছাড়াও আরো কিছু অনুষ্ঠান আছে।

বাংলাদেশ নামের জনপদটিতে বহু জাতিসত্তার বহু ভাষাভাষী মানুষের বাস, বাঙালি ছাড়াও এখানে আরও ৪৫টি জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বর্ষবিদায়কে বৈসাবি উৎসব নামে পালন করে। এখানে ত্রিপুরা জাতিসত্তার বৈসুক উৎসব, মারমা জাতিসত্তার সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার বিঝু বা বিষু উৎসবের বৈসাবির নাম পরিবর্তন করে বিজু নামে উৎসব পালনের অনুমতি দিয়েছে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ।

ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার হাজং জাতিসত্তার লোক আছে। এদের বর্ষবিদায়ের উৎসবের নাম হলো হঙ্গরানী। এরা সেদিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। ভালো রান্নাবান্না করে খায়, যাতে পরবর্তী বছর সুখের হয়। দিনে পিঠা পায়েস রান্না হয়। রাতে মঙ্গলদ্বীপ জ্বালানো হয়। মঙ্গলদ্বীপ জ্বালালে কোনো অপশক্তি আসতে পারবে না বলে এদের বিশ্বাস। এই আয়োজনে ১০৭ প্রকারের শাকসবজি দিয়ে ভাত খাওয়া হয়। এটাকে তারা মহৌষধ মনে করে। এতে শরীরের বাতব্যথা কমে।

বাংলাদেশের সাঁওতাল জাতিসত্তার লোকজন দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, নাটোরসহ আরো কিছু এলাকায় বসবাস করে। এরা ফাল্গুন মাস থেকে নববর্ষ পালন করে। এরা বাহা পরব বা ফুল উৎসব পালন করে। ‘বাহা’ শব্দের বাংলা ফুল। বাহা পরব পালিত হয় ফালগুন মাসের পূর্ণিমাতে। আদি লোকজনের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় আদিকাল থেকেই সর্বজনীন। আদিবাসী লোকজনের অংশগ্রহণে এই সর্বজনীন লৌকিক চৈতন্য বিকশিত হয়। এর ফলে এরা একতা বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বাঙালি এই সর্বজনীন লৌকিক শিল্প চৈতন্যের সঙ্গে কোনো প্রকার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে আমরাও হতে পারি একটি প্রাচীন সাংস্কৃতিক চেতনাবোধের অংশীদার।       

এখন নববর্ষ উৎসব সারা বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে উৎসব পালিত হয় তা নববর্ষের আগের দিন। যেমন চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই, সাঁওতালদের বাহা পরব বা পুল উৎসব।

রাজধানীর পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রথম দিনে নতুন হিসাব খাতা খোলেন। পুরনো বছরের খাতার হিসাব বন্ধ করে দেন। নতুন এই হিসাব খাতাই হলো হালখাতা। হালখাতায় গ্রাহকদের যাবতীয় দেনা-পাওনা লিপিবদ্ধ করা থাকে। পুরান ঢাকায় হালখাতা খোলার রীতি ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ রীতি রয়েছে। হালখাতার আর একটি নাম হলো টালি। এই খাতার ধরন বিভিন্ন রকমের। এটা ব্যবসার ধরন, পরিধি ও গ্রাহকের ওপর নির্ভর করে। এই খাতাগুলোর আকার- আকৃতি তিন-চার রকমের হয়ে থাকে। এসব তিন থেকে পাঁচ নম্বর হালখাতা হিসেবে পরিচিত। দাম খাতার ধরন অনুযায়ী হয়ে থাকে। হালখাতার রং লাল। বাংলাবাজার, চকবাজার ও নিউমার্কেট এলাকায় হালখাতা পাওয়া যায়। অতএব নববর্ষ মানেই হালখাতা আর হালখাতা মানেই দেনার হিসাব চুকানো। সঙ্গে মিষ্টি, দই, খই দিয়ে আপ্যায়ন।
বাঙালির উৎসব সংস্কৃতির নানারকম কর্মকা-ের এই ছবি আমাদের অতি চেনা। পয়লা বৈশাখ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় অনুষ্ঠানে অধিষ্ঠিত। পয়লা বৈশাখে শিল্পীরা ছবি আঁকেন। মাটি দিয়ে শৈল্পিক জিনিস গড়ে করে। পণ্য তো ভোগের জন্য। পণ্য ফুরিয়ে যায়। শিল্প সঞ্চিত থাকে। আমাদের সমৃদ্ধ করে। প্রতিটি শিল্পকর্ম স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তা আমাদের জীবনের অনিবার্য সঞ্চয়।

জুলফিয়া ইসলাম : লেখক

ঢাকাটাইমস/১৪এপ্রিল/জেডএ/টিএমএইচ