বগুড়ার লাল মরিচে নারীর আনন্দ

প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:৫০ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:৩৪

প্রতীক ওমর, বগুড়া

বগুড়ার গ্রিন চিলি (কাঁচা মরিচ) ও রেড চিলির (লাল মরিচ) সুনাম সুবিদিত। দেশের বাইরেও বেশ জনপ্রিয়। ভিন্ন স্বাদ ও ঝাঁজের কারণে বগুড়ার মরিচের চাহিদা ঝালপ্রিয় মানুষের কাছে সবার আগে। বিশেষ করে নারীদের পছন্দের শীর্ষে বগুড়ার লাল মরিচের ঝাল। একই সঙ্গে বগুড়ার শ্রমজীবী নারীদের বাড়তি উপার্জনের উপলক্ষ লাল মরিচ।

দেশের ‘খাদ্য রাজধানী’ হিসেবে খ্যাত বগুড়ায় ধান, গম, ভুট্টার পাশাপাশি প্রায় সব রকমের সবজি চাষ হয়। এসব খাদ্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হয় দেশের প্রায় সব অঞ্চলে। অনেক কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে দেশের বাইরে। জেলার ১২ উপজেলার প্রায় সব কটিতে কমবেশি মরিচের চাষ হয়ে থাকে।

লাল মরিচের চোখ ঝলসানো দৃশ্য এখন বগুড়ার চরাঞ্চলের মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে। স্থানীয় কয়েক হাজার কৃষক লাল স্বপ্নে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন। মাঠের মরিচ এখন কৃষকের গোলায় উঠতে শুরু করেছে। মাইলের পর মাইল যমুনার পাকা বাঁধে শুকানো হচ্ছে এসব মরিচ। কৃষকের এই লাল স্বপ্নের সঙ্গে মিশে আছে জেলার প্রায় ১০ হাজার নারী শ্রমিক। তাদের চোখে-মুখেও আনন্দের আভা।                      

এ মৌসুমে বগুড়া কৃষি অঞ্চলে মরিচের চাষ হয় ১০ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য প্রায় সোয়া ৩০০ কোটি টাকা। স্থানীয় বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন সেই মরিচ সরবরাহ হচ্ছে, তেমনি তা বিদেশের বাজারও দখল করছে এখন। ফলনের পাশাপাশি বাজারে দামও ভালো পাওয়ায় খুশি কৃষক।

মরিচের চাষ সবচেয়ে বেশি হয় যমুনা বিধৌত সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলে। বরাবরই মরিচ চাষের জন্য বিখ্যাত এই চর এলাকা। প্রতি বছরের মতো এ বছরও যমুনার চরে বাম্পার ফলন হয়েছে মরিচের। বন্যায় প্রচুর পরিমাণ পলিমাটি জমিতে পড়ার ফলে নদী তীরবর্তী এলাকাতে মরিচের চাষ ভালো হয়। এবার শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলায় চাষ হয়েছে ৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে।  

লাল টুকটুকে পাকা মরিচ জমি থেকে তোলার পর ১৫ দিন রোদে শুকানোর পর বাজারজাত করা হচ্ছে। আর এই শুকনা মরিচের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় হাট-বাজারে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতি মণ শুকনা মরিচ প্রায় ৪ হাজার ৮০০ টাকা থেকে  ৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর তীর বা স্থানীয় চাতালগুলোতে গেলে এখন টের পাওয়া যায় মরিচের ঝাল। যমুনার নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের জন্য যে ঢালগুলো রয়েছে, সেসব স্থান এখন মরিচ চাষি ও ব্যবসায়ীদের দখলে। একই অবস্থা চাতালগুলোরও। চর থেকে মরিচ তুলে এনে সেসব মরিচ শুকানো ও পরিচর্যার (বাছাই) কাজ করা হচ্ছে সেখানে।
হাটশেরপুর ইউনিয়নের মরিচ চাষি ফজলুল করিম শেখ জানান, তিনি এবার ৮ বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছেন। দামও পাচ্ছেন বেশ ভালো। বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পাইকাররা। আগের মতো বাজারে ছুটতে হচ্ছে না কৃষকদের।  অনেক সময় পাইকাররা ছুটে আসছেন জমিতে। জমির পরিমাণ ও ফলন দেখে বিঘা চুক্তি সেসব মরিচ কিনে নিচ্ছেন আগাম। প্রতি বিঘার মরিচ কেনা হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায়।

সরাসরি জমি থেকে মরিচ কেনার বিষয়ে পাইকারদের ভাষ্য, বাজারের চেয়ে খেতে গিয়ে মরিচ কিনলে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। এ জন্য তারা জুম থেকে মরিচ কিনছেন।

জমি থেকে আধাপাকা মরিচ কেনা হচ্ছে আকৃতিভেদে ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা মণ। সেসব মরিচ কেউ আড়তে নিয়ে, কেউ বা দেশের খ্যাতিমান বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সরবরাহ করছেন। আর সেসব কোম্পানির মাধ্যমে দেশের বাজার ছাড়িয়ে তা পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশের বাজারেও।

নারী শ্রমিকদের মুখেও আনন্দের ঢেউ

চরাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার নারী শ্রমিকের বাড়তি উপার্জনের ব্যবস্থা হয়েছে এই মরিচ চাষের কারণে। সরেজমিনে এসব নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের খুশির কথা। জমি থেকে মরিচ তোলা ও পরিচর্যার (বাছাই) কাজ মূলত নারী শ্রমিকরাই করে থাকেন। পুরুষের পাশাপাশি মরিচের মৌসুমে নারী শ্রমিকদের বাড়তি আয়ে স্বচ্ছল হচ্ছেন এসব শ্রমজীবী পরিবারগুলো।

আয়শা, মরিয়ম, ললিতা রানী জানান, মরিচ তুলে প্রতিদিন তারা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন।

কল্পনা আক্তার নামের একজন নারী শ্রমিক জানান, তার স্বামীও দিনমজুর। তাদের দুটি সন্তন আছে। তারা স্কুলে যায়। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগান দিতে স্বামীর পাশাপাশি তিনিও কাজ করছেন মরিচের জমিতে। মরিচ তোলার মৌসুম শুরু হয়েছে মাস খানেক আগে, চলবে আরো আন্তত ১৫ দিন। এই মাস দেড়েক সময়ে নারী শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। বছরে এ রকম ফসল তোলার মৌসুম আরো দুই তিনটি পেয়ে থাকেন তারা। বিশেষ করে ভুট্টা, আলু ও ধানের মৌসুম।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য

মৌসুমের শুরু থেকেই মাঠে মাঠে তৎপর হয়ে ওঠেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা কৃষকের জমিতে গিয়ে আনুমানিক মূল্যে পুরো ফসল কিনছেন। তারপর মরিচ তুলে শুকিয়ে বিক্রি করছেন ঢাকার নামিদামি কোম্পানিতে। এতে দ্বিগুণ লাভবান হচ্ছেন তারা। খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ না থাকায় কৃষকরা অনেকটা জিম্মি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে।

বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার জানান, বগুড়ায় এবার মরিচ উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার যেমন মরিচের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে, তেমনি দামও ভালো।

(ঢাকাটাইমস/১৬এপ্রিল/মোআ)