সিটিং বন্ধ: যাত্রীদের ‘শিক্ষা দিচ্ছে’ বাস মালিকরা

প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:৩৬ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৪৬

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

ঘোষণা দিয়েও সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়নি-এই বাস্তবতায় বাস মালিকদের বাধ্য করতে অভিযানে নেমেছে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই পরিস্থিতিতে রাজধানীতে সিটিং বা ডাইরেক্ট নামে চলা বাসের একটি অংশ লোকাল হিসেবে চলা শুরু করেছে। কিন্তু এই বাসগুলো আবার তাদের সেবার মান কমিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করে। একজন বাস মালিক ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, লোকাল হওয়ার কী সমস্যা যাত্রীদের সেই শিক্ষা দিচ্ছেন তারা।

সিটি সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর স্টপেজে স্টপেজে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় দাঁড়িয়ে যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি, ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তোলা, ভেতরের ফ্যান বন্ধ করে রাখাসহ যাত্রীদের হয়রানি করছে পরিবহন শ্রমিকরা। এসব নিয়ে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেই তারা বলছেন, সিটিং থেকে লোকাল হলে এটা মেনেই নিতে হবে।

আইনে সিটিং বলতে কিছু নেই। বাসে আসনের অতিরিক্ত না তুললেও সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আসন হিসেবে যাত্রী তোলা হবে- এই ঘোষণা দিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করে চলছিল বাসগুলো।

আবার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি আদায় করা হলেও বাসগুলো থামে জায়গায় জায়গায়। ডেকে ডেকে যাত্রী ঠিকই তোলে। সিটিং নামে চললেও আসনের বেশি যাত্রী তোলা হবে না- এই নিশ্চয়তাও দেয়া যায় না।

এমনিতে বিআরটিএ পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে যে ভাড়া নির্ধারণ করে তাতে বাসগুলোতে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করবে না, তাই ধরা হয়ে থাকে। আসলে পুরো আসন না, শতকরা ৮০ শতাংশ আসনে যাত্রী বহন করলে কত খরচ হয়, সেই বিবেচনাতেই নির্ধারণ করা হয় ভাড়া। কিন্তু কি সকাল, কি দুপুর, কি রাত, জনাধিক্যের এই নগরে যাত্রীর চাপ সব সময়ই থাকে। ফাঁকা আসনে বাস চলার দৃশ্যই এখানে বিরল।

এই অবস্থায় সিটিং, ডাইরেক্ট বা স্পেশাল নামে বাস সার্ভিস নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার অসন্তোষ জানিয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। আর গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদনের পর পরিবহন মালিকরা গত ৪ এপ্রিল ঘোষণা দেন ১৫ এপ্রিল থেকে ঢাকায় কোনো বাস সিটিং নামে চলবে না।

কিন্তু ১৫ এপ্রিলও সিটিং সার্ভিস নামে বাস ঠিকই চলছে। আর পরদিন রবিবার থেকে নামে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই অভিযানকে সামনে রেখে বেশ কিছু সিটিং সার্ভিসকে লোকাল হতে দেখা যায়।

মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বহন

কিন্তু এই পরিবর্তনে লাভ কতটা হয়েছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ সিটিং সার্ভিস লোকাল হওয়ার পরও ভাড়া কমেনি বাসগুলোতে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গরমে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বহন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন মালিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা এখন ইচ্ছেমতো যাত্রী উঠাব। লোকাল গাড়িতে চড়ার মজা বুঝবে যাত্রীরা।’

এই বিষয়টি অবশ্য সরকারের নজর এড়ায়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবারই বলেছেন, আসনের অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হবে বলে মাত্রাতিরিক্ত তোলা যাবে না। তিনি বলেন, ‘যারা পয়সা দিয়ে গাড়িতে ওঠে, অনেকে বসতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকে এবং খুবই ওভার লোডিং হয়। এই ওভার লোডিং এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওভার লোডিং না হলে এবং শৃঙ্খলা ফিরে আসলে জনগণ সুফল অবশ্যই পাবে।’  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, ‘বিআরটিএর সঙ্গে আমাদের কথা অনুযায়ী আসনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে।’

তাই বলে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নেয়া হবে? মন্ত্রীও তো এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন- এমন মন্তব্যের জবাবে এই বাস মালিক বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের এই বিষয়টা আমি জানি না, তবে বিআরটিএ থেকে আমাদেরকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

ফ্যান বন্ধ রাখা

সাভার থেকে চিটাগাং রোডে চলাচলকারী ঠিকানা এক্সপ্রেসের যাত্রীরা তুললেন আরেক অভিযোগ। তারা জানান, সিটিং সার্ভিসটি লোকাল হয়ে যাওয়ার পর এই গরমেও ফ্যান ছাড়তে চাইছিলেন না না পরিবহন শ্রমিকরা। এ নিয়ে ঝগড়া আর বাকবিতণ্ডার পর ফ্যান ছাড়া হয়।

‘কমিয়ে দেয়া হয়েছে’ বাসের সংখ্যা

আবার রবিবার স্বাভাবিকের তুলনায় বাসের সংখ্যাও দেখা গেছে কম। আসাদগেট, ফার্মগেট, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব এলাকা ঘুরেই এই চিত্র দেখা যায়। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা বলছিলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা গাড়ি কমিয়ে দিয়ে চাপ দেয়ার চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, ‘গাড়ির সংখ্যা কয়েকদিন কমবে। আমরা এ ব্যবস্থা চলামান রাখবো যেন নিয়মের মধ্যে আনতে পারি। আমরা বিষয়টি নজরে রাখছি।’

লোকাল হওয়ার পর কমেনি ভাড়া

এ তো গেল ভোগান্তির কথা। সিটিং সার্ভিস করার নামে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করা বাসগুলো লোকাল হওয়ার পরও সেই আগের ভাড়াই আদায় করছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

চিটাগাং রোড থেকে সাভারের কালামপুর পর্যন্ত চলাচলকারী ‘ঠিকানা এক্সপ্রেস’ পরিবহনটি আগের দিনও চলেছে সিটিং হিসেবে। রবিবার সকাল থেকে বাসটি হয়েছে লোকাল। তবে ভাড়া কমেনি এক টাকাও। সাইনবোর্ড থেকে কালামপুর পর্যন্ত তারা ভাড়া রাখছে ৫৪ টাকা। পথে পথে যাত্রী ওঠা-নামা করেছে তারা।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বড় বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা, আর মিনিবাসের পাঁচ টাকা। কিন্তু এই বাসটি প্রতিটি স্টপেজে সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে সাত টাকা।

জানতে চাইলে এই পরিবহন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রিপন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা বিআরটিএর চার্ট অনুয়ায়ী ভাড়া নিচ্ছি। সিটিং বাদ দেয়ায় আগের চেয়ে এখন আমরা দ্বিগুণ যাত্রী তুলতে পারব। আমাদের ইনকামও আগের চেয়ে বেশি হবে। আমরা যাত্রীদের সুবিধায় সিটিং সার্ভিস করেছিলাম। এখন এ সার্ভিস উঠিয়ে নিলে আমাদের করার কিছু নেই।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহও এই অভিযোগ অস্বীকার করেননি। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এটা একদিনে শেষ হবে না। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।’

(ঢাকাটাইমস/১৭ফেব্রুয়ারি/জেআর)